২২ নভেম্বর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২২ নভেম্বর ২০২৫

মনোনয়ন নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল, বঞ্চিতদের মধ্যে বিদ্রোহের আভাস

মনোনয়ন নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল, বঞ্চিতদের মধ্যে বিদ্রোহের আভাস

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টালমাটাল অবস্থায় বিএনপি। পাঁচটি আসনের মধ্যে ঘোষিত চারটিতে মনোনয়ন-বঞ্চিত নেতা ও তাদের সমর্থকরা প্রকাশ্যে মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ, সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে হাইকমান্ডে লিখিত অভিযোগ পর্যন্ত দিচ্ছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও জেলার বিভিন্ন স্থানে এই প্রকাশ্য বিদ্রোহ বিএনপির সাংগঠনিক সংকট আরো বাড়িয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিতদের কার্যক্রম দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে উস্কে দিচ্ছে এবং যা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবারও আভাস বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, সামনের দিনগুলোতে মনোনয়ন-বঞ্চিতদের এ কার্যক্রম আরও তীব্র হবে। এমনকি প্রার্থী বদল না হলে আসনগুলোতে মনোনয়ন-বঞ্চিতরা একত্র হয়ে একজনকে স্বতন্ত্র করারও পরিকল্পনা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থান নির্বাচনী মাঠে দলটির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। কেননা, শীর্ষ নেতাদের দ্বন্দ্বে দ্বিধা-বিভক্তি তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে-অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সুবিধা দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের প্রার্থীদের।

গত ৩ নভেম্বর স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সারাদেশে ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বিএনপি। নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটিতে চূড়ান্ত প্রার্থী দেয় দল। তবে কৌশলগত কারণে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি।

দলীয় সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান দিপি ভূঁইয়া, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নির্বাহী কমিটির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নান ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি সমাজসেবক মাসুদুজ্জামান মাসুদকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয় বিএনপি।

এর আগে গত ২৭ অক্টোবর বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ডাকা হয়। ওই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওইদিন দলের হাইকমান্ড স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেন যে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, সকল নেতা-কর্মীকে তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা তাতে সম্মতি জানালেও, বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ধানের শীষের মনোনীত প্রার্থীর সরাসরি বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে বিএনপিতে একটি ভিন্ন বার্তা যাচ্ছে। এই ধরনের আচরণ বা প্রকাশ্য শৃঙ্খলাভঙ্গ দলের জন্য নেতিবাচক ফলাফব বয়ে আনবে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, যা নির্বাচনী মাঠে এবং সাংগঠনিকভাবে দলটির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

নারায়ণগঞ্জ -১ আসনে মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দীপু মনোনয়ন পেলেও তার পক্ষে এখনো মাঠে দেখা যায়নি একই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে।

তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য লবিং করে যাচ্ছেন মনিরুজ্জামান। ফলে, তার কর্মী-সমর্থকেরও দেখা যায়নি মনোনীত প্রার্থীর কোনো কর্মসূচিতে। এমনকি বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ-১ রূপগঞ্জের বিএনপির মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে উপশহরের ৩০০ ফিটে মশাল মিছিল করেন আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ দুলাল হোসেনের অনুসারী নেতাকর্মীরা। এ সময় “অবৈধ নমিনেশন মানি না, মানবো না” বলে স্লোগান দিতে দেখা যায় মিছিলকারীদের।

নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম আজাদের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে রাজপথে নেমেছেন মনোনয়ন-বঞ্চিত নেতারা। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি আতাউর রহমান খান আঙ্গুর, কেন্দ্রীয় সহ অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পারভীন আক্তার। 

গত ১০ নভেম্বর বিকেলে আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির কার্যালয় মাঠ প্রাঙ্গনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ঘোষিত “বিপ্লব ও সংহতি দিবস”-এর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিভেদ ভুলে এক মঞ্চে উঠেন মনোনয়ন বঞ্চিত তিন বিএনপি নেতা। এ সময় তাদের হাজারো কর্মী সমর্থক মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানান।

গত মঙ্গলবার রাতে আজাদের বিরুদ্ধে মশাল মিছিলও করে বিএনপির একাংশ। তাদের মধ্যে মনোনয়ন-বঞ্চিতদের অনুসারীরাও উপস্থিত ছিলেন।

নেতাকর্মীদের দাবি, নজরুল ইসলাম আজাদের মনোনয়ন অবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করা হোক।

একই রাতে নজরুল ইসলাম আজাদের ছোটভাই রাকিবের নেতৃত্বে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেন আজাদ অনুসারী নেতাকর্মীরা। 

নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও ও সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে মনোনীত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের বিরুদ্ধে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত নালিশ দিয়েছেন মনোনয়নবঞ্চিত সাত নেতা। তারা হলেন: সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ওয়ালিউর রহমান আপেল, সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু জাফর, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আল মুজাহিদ মল্লিক।

তাদের অভিযোগ, মনোনীত প্রার্থী মান্নানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এবং তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের পুনর্বাসন এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে। 

মনোনয়ন বদলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের মত কর্মসূচিও পালন করেছেন মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের অনুসারীরা। 

কাচপুরে একইস্থানে একইসময়ে মনোনীত প্রার্থী ও মনোনয়ন বঞ্চিতরা কর্মসূচি দিলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় পরে সংঘাত এড়াতে আজহারুল ইসলাম মান্নানের সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে পিরোজপুরে ইউনিয়নে নেয়া হয়।  

নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে আলোচিত আসন হচ্ছে ​নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন। এখানে দলের মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন মহানগর বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতারা। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মনোনয়ন বঞ্চিতদের দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেও তারা সংবাদ সম্মেলন করে অনাস্থা প্রকাশ করেন।

তারা হলেন: বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কালাম, মহানগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ী আবু জাফর আহমেদ বাবুল।

তারা গত শনিবার ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিদ্ধান্তের প্রতি অনাস্থা জানান এবং তাদের মধ্য থেকে কাউকে প্রার্থী করার দাবি করেন। এছাড়া প্রতিদিন মনোনয়ন বঞ্চিত ৪ নেতা একত্রে ৩১ দফার লিফলেট ও ধানের শীষের প্রচারণা করছেন।

​দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যখন 'গণঅভ্যুত্থানের পর ক্লিন ইমেজ, জনসম্পৃক্ততা, সাংগঠনিক অবদান, বিরোধহীন মনোভাব নেতৃত্বের' ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচনের কথা বলছে, তখন নারায়ণগঞ্জে এই কোন্দল একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। এই বিদ্রোহের ফলে দলীয় নির্দেশনার প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে; তারেক রহমান স্পষ্ট নির্দেশনা দিলেও নারায়ণগঞ্জ-৫ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করা দলের শৃঙ্খলা ও হাইকমান্ডের প্রতি চরম অনাস্থা প্রদর্শন করে বলে অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের।

যদিও আসনটিতে মনোনয়নকে ঘিরে নানা প্রতিকূলতা, অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ ও বিরোধ সামলেও শেষ পর্যন্ত মাসুদুজ্জামান তৃণমূলের বিভিন্ন বলয়কে একত্র করতে সক্ষম হয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী না দিলেও মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু, জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি। এছাড়া, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তারা নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন চাইলেও সেখানে না পেয়ে এ আসনটির জন্য কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন। তবে, দল এখনো কাউকে চূড়ান্ত করেনি।

তবে আলোচনা রয়েছে এখানে জোটগত প্রার্থী দেয়া হতে পারে সেইক্ষেত্রে এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের কেউ কেউ নির্বাচন করতে পারেন বলে অভিমত নেতাকর্মীদের।  

নারায়ণগঞ্জের মতো শিল্প ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় আসনগুলোতে এই তীব্র কোন্দল ও প্রকাশ্য বিদ্রোহ যদি দ্রুত নিরসন না করা হয়, তবে নির্বাচনে এই আসনগুলো বিএনপির হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি প্রবল। কোন্দল নিরসনে ব্যর্থতা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকে তুলে ধরবে। এছাড়াও আসনগুলোতে শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের লড়াইয়ে মেতে ওঠা তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছে। এতে ভোটের মাঠে কর্মীদের সক্রিয়তা কমে আসবে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়