জনরোষের মুখে পালিয়ে যায় ওসমান পরিবার

৫ আগস্ট ২০২৪। সকাল। চোখেমুখে তখনও অনিশ্চয়তা। তবুও কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে নারায়ণগঞ্জবাসী। কপালে বাঁধা পতাকা যেন নিজের কাফনের কাপড়। মৃত্যুভয়কে চিতায় তুলে ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগানে শহরের ছাত্র-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে এক অসম লড়াইয়ে। এই জনজোয়ারে ভেঙে পড়ে নারায়ণগঞ্জকে দশকের পর দশক জিম্মি করে রাখা ‘ওসমানীয় সাম্রাজ্য’।
তবে, নিজেদের অস্তিত্ব বিলীনের শঙ্কায় শেষ চেষ্টা চালিয়েছিল ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী বাহিনী। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবিতে যখন গণভবন অভিমুখে সারাদেশবাসীর যাত্রা, নারায়ণগঞ্জ শহরেও নেমে এসেছিল হাজারো ছাত্র-যুব-তরুণ ও নানা শ্রেণিপেশার আবাল-বৃদ্ধ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর কয়েক ঘন্টা আগে সকালে যখন গণভবনমুখী ছাত্র-জনতা যখন নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় জড়ো হচ্ছিলেন, তখন মুক্তিকামী জনতার উপর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফের ঝাপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী।
ওইদিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক ও সলিমুল্লাহ সড়কে তিনভাগ হয়ে চাষাঢ়ায় সাধারণ নিরস্ত্র জনতার উপর হামলার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। সকালে তারা ছাত্র-জনতার উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালান, চলে মুহুর্মুহু গুলিও। ওইদিন গুলিতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
তবে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করা ছাত্র-জনতাকে বুলেট ভীত করতে পারেনি। পাল্টা ধাওয়া দেন তারাও। দীর্ঘ দেড় দশকের অত্যাচার-নির্যাতন-গুম-খুন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তির মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী বাহিনী। শহর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান শামীম ওসমান, তার ভাই সেলিম ওসমান, তাদের পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা।
কয়েক ঘন্টা পর যখন শেখ হাসিনার ভারতে পালানোর ঘোষণা আসে তার আগেই জনতার বিস্ফোরণে পতন হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের ওসমানীয় সামাজ্র্যের। দুপুরের পর হাজারো মানুষ নেমে আসেন শহরে। শহরতলীর অলিগলিও ভরে ওঠে মানুষের, তাদের মুখে বিজয়ের তৃপ্তি।
ওইদিন শামীম ওসমানের জামতলার বাড়ি, তার বড়ভাই একেএম সেলিম ওসমানের উত্তর চাষাঢ়ার বাড়িতে হানা দেয় বিক্ষুব্দ জনতা। চলে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট। সেলিম ওসমানের বাড়িতে আগুনও দেওয়া হয়।
শহরের চাষাঢ়ায় ‘বায়তুল আমান’ ভবনেও ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়। এই ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী। ভবনটিতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বেশ কিছু বৈঠক হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানেরও যাতায়াত ছিল। ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানুষের তৈরি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ভবনটির সামনে জনতার উল্লাসের মধ্য দিয়ে।
ভাঙচুর চালিয়ে লুট করা হয় কলেজ রোড এলাকার শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন ও ভাতিজা আজমেরী ওসমানের ব্যক্তিগত কার্যালয়। এই দু’টি কার্যালয় থেকে শহরে ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়াতেন এই দুই ওসমানপুত্র।
এমনকি শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি তোলারাম কলেজ যেটি ছিল শামীম ওসমান ও তার ছেলের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে, সেই কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদে ঢুকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কলেজে সাঁটানো শামীম ওসমান ও তার পরিবারের লোকজনের ব্যানার-ফেস্টুন ছিঁড়ে পদদলিত করে আগুনে পুড়িয়ে দেন বিক্ষুব্দরা।
নগরীর চাষাঢ়ায় নাসিম ওসমান (শামীম ওসমানের প্রয়াত বড়ভাই) প্লাজা নামে একটি নির্মাণাধীন ভবনে থাকা একটি রেস্তোরাঁও ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
লুটপাট চলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবেও। ক্লাবের নির্মাণাধীন ভবনে থাকা নির্মাণসামগ্রীও লুট হয়। বিত্তশালীদের এই ক্লাবটির নিয়ন্ত্রণ ছিল ওসমান পরিবারের সদস্যদের কাছে। আন্দোলন চলাকালীন ১৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের উপর হামলার সময়ও এ ক্লাবটি ব্যবহার করেছিল শামীম ওসমান ও সন্ত্রাসী বাহিনী।
ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এমএ রশিদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতা, সন্ত্রাসী বাহিনীর হোতা অনেকের বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চলে পরের কয়েকদিনও।
স্থানীয়রা বলেন, ওসমান পরিবারের সদস্য কয়েক দশক নারায়ণগঞ্জ শহরকে জিম্মি করে রেখেছিল। গুম, খুন, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জকে দিয়েছিল ‘সন্ত্রাসের জনপদ’র পরিচিতি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে দেড় দশক আগে এই পরিবারের সদস্য এবং চারবারের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ‘গডফাদার’ তকমা পান। ওসমান পরিবারের সদস্য ও সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী, তরুণ আশিকুল ইসলাম, নাট্যকর্মী মাহবুবুর রহমান চঞ্চল, ব্যবসায়ী ভুলুসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ত্বকী হত্যা মামলায় র্যাবের এক খসড়া চার্জশিটে জানা যায়, শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধের জেরে এ শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রফিউর রাব্বির কিশোর ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। পরে লাশ গুমের জন্য ফেলা হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। এই পুরো কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান। এই হত্যাকাণ্ডে তার ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা শাহ নিজামেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
যদিও তাদের কেউই এখন আর দেশে নেই। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে ওসমান পরিবারের লোকজন অনেকে বিদেশে পালিয়েছেন এবং বাকিরা দেশেই আত্মগোপনে আছেন। তবে, কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভেড়ার চেষ্টাও রয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে দশকের পর দশক রাজত্ব করা ওসমান পরিবারের ‘সাম্রাজ্য’ অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণজাগরণে ভেঙে পড়ে। জনতার এই বিস্ফোরণ তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। গডফাদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনরোষ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, নারায়ণগঞ্জ তার জীবন্ত উদাহরণ।
শহরজুড়ে ওসমান পরিবারের প্রতীকী ও বাস্তব সবকিছু ভেঙে পড়ার মাধ্যমে এই বার্তা স্পষ্ট হয়Ñ জনগণের ঘৃণা এবং প্রতিরোধের মুখে গুম-খুন আর দখলের রাজনীতির দিন শেষ। যে শহরকে তাঁরা একসময় জিম্মি করে রেখেছিলেন, সেই শহরের মানুষই তাঁদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, ওসমান পরিবারের নারায়ণগঞ্জে পুনরুত্থানের আর কোনো সামাজিক ভিত্তি বা জনআস্থা অবশিষ্ট নেই। গণজাগরণের যে শক্তি এই দানবীয় শাসন ভেঙে দিয়েছে, তা এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করেছে। এখনকার নারায়ণগঞ্জ আর কখনোই ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ নয়Ñ এটি হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ ও গণতন্ত্রের প্রতীক।