রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না: বদিউল আলম
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “আমরা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছি। এবং এই রক্তের প্রতি আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। তাই আমি আমার অবস্থান থেকে এই কাজটা করার চেষ্টা করছি। সুজনের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সকলকে অনুরোধ করবো যেন, আপনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পক্ষে কাজ করবেন, যাতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।”
তিনি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানে গণভোটের জন্য নাগরিকদের উৎসাহিত করেন।
শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে সুজনের জেলা কমিটির “কোন পথে সুষ্ঠু নির্বাচনের ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
“সচেতন, সংগঠিত, সোচ্চার জনগোষ্ঠীই গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ” এই স্লোগানকে সামনে রেখে মতবিনিময় সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার।
সুজনের জেলা সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েলের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আনন্দোলনের আহ্বায়ক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি, নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাড. আবু বক্কর সিদ্দিক, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাড. মাহবুবুর রহমান মাসুম, গণতান্ত্রিক আইনজীবী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আওলাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়, নগর ভাবনার আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস, নারায়ণগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক রুমন রেজা, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘হতাশার অনেক কারণ আছে। কারণ এই সরকার ক্ষমতায় এসছে যে, অতীতে গত ১৫-১৬ বছরে যে সকল অন্যায় অসংগতিগুলো হয়েছে, তার থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষে। পাশাপাশি একটি সুষ্ঠ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে বিদায় নেওয়া। ইতোমধ্যে এই সরকার দুর্ভাগ্যবশত অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কথা বলতে পারি, কিন্তু এতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না।’
“আমাদের অনেক হতাশা-নিরাশা আছে, অনেক প্রশ্ন আছে? এর মধ্যেও যদি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে যেন নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। প্রত্যাশা করি আমরা ভালোর দিকে যাব। আমরা সকলেই যদি মোমবাতি জ্বালানোর কাজটা করি, সচেতন ও সোচ্চার এবং সকলেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করি তাহলেই হয়ত বা ভালোর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে।’
সংস্কারের প্রশ্নের উত্তরে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, এই সরকার গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা কমিশন, সংবিধান সংস্কার, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এরপরে আরও পাঁচটি গঠন করা হয়েছে। এবং প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশন যখন তাদের তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে আমি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ছিলাম। এরপর সরকার ঐক্যমত কমিশন গঠন করেছে। ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশনে যেই সুপারিশগুলো করা হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে ১৬৬ টি বেছে নিয়েছি। যেগুলোতে রাজনৈতিক দলেগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা করা এবং ঐকমত্য সৃষ্টি করা দরকার। আর বাকিগুলো সরকার যে নির্বাহী আদেশে কিংবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এবং সেই তালিকাও দিয়ে দিয়েছি সরকারের কাছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এর অধিকাংশ হয়নি। এবং কয়েকদিন আগেই আমি একটি আলোচনায় বলেছি যে, আমি সন্তুষ্ট নই। সরকার যেগুলো করেছে আর বাকি পাঁচটি যে, সংস্কার কমিশন। এই সংস্কার কমিশনের প্রায় সবগুলোই নির্বাহী আদেশ এবং সরকার ওই অধ্যাদেশের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারতো। এখনো পারে ভবিষ্যতেও পারবে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশনগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐক্যমত হওয়ার দরকার নেই। বিশেষত রাজনৈতিক ঐক্যমত হওয়ার দরকার আছে যে সংবিধান সংস্কারের ব্যাপারে এবং কতগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের ঐক্যমত সৃষ্টি হওয়। আর যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ যে বিষয়ে ঐক্যমত সৃষ্টি হওয়ার দরকার আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আমরা চেয়েছিলাম একটা স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে। প্রথম এই ১৬৬ টা স্প্রেডশিট তৈরি করে রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছি, তাদের মতামত নিয়েছি তারপরে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের সাথে আমরা এককভাবে বসেছি আমরা ছয় জন ঐক্যমত কমিশনের পক্ষে। তারপরে আমরা ৩০ টা রাজনৈতিক দলের সাথে একত্রে বসেছি এবং আলাপ আলোচনার ভিতরে ৮৪টি বিষয় ঐক্যমত হয়েছে। কোন কোন বিষয়ে দ্বিপত রয়েছে। যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত সৃষ্টি হয়েছে তার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণিত হয়েছে এবং অধিকাংশ দল এটা স্বাক্ষর করেছে। এবং তাদের সম্মত হয়েছে এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে এবং এগুলো থেকেই এই এগুলো থেকে ৪৮ টা আছে যেগুলো সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত আর বাকি ৩৬টি সরকার যেগুলোর ব্যাপারে ঐক্যমত হয়েছে। ৮৪ টার মধ্যে ৩৬ টা প্লাস ৪৮ টা মোট ৮৪ টা। এই ওই ৩৬ টা সরকার অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারবে। বাকি ৮৪ টি বিষয়ে গণভোট হবে। সংবিধান হল উইল অফ দি পিপল, জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি। তাই জনগণের মতামত ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সমুচিন নয় এবং সংবিধানের অনেক কিছু জনগণের সম্মতি ছাড়া করা যায় না। কতগুলো বেসিক স্ট্রাকচার আছে। মৌলিক কাঠামো আছে যেগুলো সংসদেও সেগুলো সংস্কার করতে পারে না। গণভোটের দরকার কিংবা গণপরিষদ দরকার।’
সুজনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক বলেন, ‘এইযে ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব যার মধ্যে একই সময় প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান এবং সংসদের প্রধান হতে পারবে না। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করনসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান, যেগুলোকে দলীয়করণ করেনের মাধমে অকার্যকর করা হয়েছে। সেগুলোকে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমনভাবে নিয়োগ দেওয়া। যাকে তাকে নেিয়াগ না দেওয়া যেমন, নুরুল হুদার মত ব্যক্তিরা যেন, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা। এবং বিচার বিভাগ নিয়ে কারসাজি না হয়, সেজন্য বিচার বিভাগের নিয়োগ এবং একই সাথে প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে যেন, জেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যারা সংসদে থাকবে তাদের সম্মিলিত সংসদে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী দলের নেতা নেত্রী, সংসদের উপনেতা এদের সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তত্ত্বাবধক সরকার প্রদান হবে। যাতে অতীতের মত কারসাজি না হয়।’
নারী কমিশন নিয়ে বদিউল আলম মজুমদার তিনি বলেন, ‘নারীর বিষয়ে হয়েছিল দুর্ভাগ্যবসত আপনি যে প্রশ্ন আমাকে করেছেন, ওই প্রশ্নগুলো আমাদের রাজনীতিবিদদেরকে করেন। আমাদের যেটা হয়েছে নারীর ন্যাজ্য অধিকার পরাজিত হয়েছে। কিন্তু প্যাট্রিয়ার কি তার মানে পুরুষতন্ত্র জয়ী হয়েছে। আমি বহু লড়াই করেছি নারীর অধিকার, নারীর রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কিন্তু সফল হয়নি। এর কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি। এরকম অনেকগুলো মৌলিক সংস্কারের বিষয় এই গণভোটে অন্তর্ভুক্ত হবে।’
সুজনের এই নেতা বলেন, ‘ওইযে আপনারা অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছেন, আমারও সন্দেহ আছে নির্বাচন করা যাবে কি না। কারণ আমরা যে সকল সংস্কার প্রস্তাবগুলো করেছিলাম এগুলোর অধিকাংশই হয়নি। কিন্তু আমি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যেমন প্রস্তাব করেছিলাম যে, রাজনৈতিক দলের গণতায়ন রাজনৈতিক দলের আর্থিক স্বচ্ছতা এবং যে রাজনৈতিক দল মনোনয়ন পত্র দেবে তাদের নেতাকর্মীদের যে প্যানেল তৈরি করবে স্থানীয় পর্যায় তার ভিত্তিতে এগুলো কোনটাই রাখা হয়নি।’
‘দুর্ভাগ্যবশত ওই যে হাসনাত আব্দুল্লাহ আদালতে গিয়েছে, আদালতে গিয়ে লড়েছে তাও কোন প্রতিকার পায়নি। পাশাপাশি আমি নিজে গিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলাম আদালতে। আমাদের হতাশা আছে হাল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমরা এই কাজটা করছি আমাদের নিজেদের জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। আমরা কিন্তু রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছি। এবং এই রক্তের প্রতি আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। তাই আমি আমার অবস্থান থেকে এই কাজটা করার চেষ্টা করছি। সুজনের পক্ষ থেকে আমাদের সকলকে অনুরোধ করব যেন, নিজনিজ অবস্থান থেকে সুষ্ঠ নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক উত্তোরণের মধ্য দিয়ে একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এবং গণভোট যেন নির্বাচিত হয়, কারণ গণভোট পাশ না হলে আবারও পুরান অবস্থায় আমরা ফিরে যাব এবং যেটা কারো জন্য কাঙ্খিত হবে না।’
সংগঠনটির জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফুল হকের সঞ্চলনায় আরও উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা মইনুদ্দিন আহমাদ, বাসদের সেলিম মাহমুদ ও এনসিপির আহমেদুর রহমান তনু প্রমুখ।





































