সিদ্ধিরগঞ্জে বিস্ফোরণের কারণ গ্যাস নাকি ফ্রিজ?

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে টিনসেড বাড়িতে বিকট শব্দে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নয়জন দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক শিশু ও এক নারী মারা গেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও সাতজন। তাদের শারীরিক অবস্থায়ও সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
গত শনিবার ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী পূর্বপাড়া এলাকার একটি টিনসেডের বাসায় হঠাৎ বিস্ফোরণের পর আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে পাশাপাশি দু’টি ঘরের অন্তত ৯ জন দগ্ধ হন।
এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটির কারণ ও আগুনের উৎস নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার দিন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসারের কথা বললেও স্থানীয় এলাকাবাসীর জোর দাবি, তিতাসের লিকেজ থেকে ঘরে জমা গ্যাসই বিস্ফোরণের কারণ।
শনিবার ভোরে আগুনের ঘটনার পর খবর পেয়ে বাড়িটিতে আগুনে নেভাতে কাজ করে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কাঁচপুর ও আদমজী স্টেশনের দু’টি ইউনিট। ঘটনাস্থলে থাকা আদমজী স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মিরন মিয়া প্রাথমিক তদন্তের বরাতে সাংবাদিকদের জানান, একটি ঘরে থাকা ‘বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে রেফ্রিরেজটরের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত’ হলে আগুনের ঘটনা ঘটে।
যদিও এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় এলাকাবাসীর অনেকে দাবি করে আসছেন, তিতাসের লাইনের লিকেজ থেকে ঘরে জমা গ্যাসের বিস্ফোরণে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ বাড়িতে এর আগেও আগুনের ঘটনা ঘটেছিল বলেও একাধিক প্রতিবেশী জানান।
চারদিকে পাকা এবং উপরে টিনসেড দেওয়া এ বাড়িটিতে কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। ঘটনার সময় পাশের আরেকটি ঘরে ছিলেন নিহত তাহেরার নাতনির স্বামী মো. ইব্রাহীম। তিনি বলেন, “রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে বিকট শব্দে ঘুম ভাঙার পর বেরিয়ে দেখি আসমা, সালমা, তৃষা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের মাথা ও পুরো শরীরে তখনও আগুন জ্বলতেছে। পরে আমরা তাদের আগুন নিভিয়ে হাসপাতালে পাঠাই।”
এ বাড়ির মালিক জাকির খন্দকার পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর উত্তরাতে। বাড়িটিতে প্রায় সময়ই গ্যাসের কটু গন্ধ পাওয়া যেত এবং বছর দেড়েক আগেও এ বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে, সে সময় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ওই সময়ও গ্যাসের লিকেজের কারণে আগুন লেগেছিল বলে দাবি করেন ইব্রাহীম। “এই বাসায় শুরু থেকেই গ্যাস লিকেজের প্রবলেম আছে। এখনও দেখবেন বাড়ির ভেতর গন্ধে থাকা যায় না”, যোগ করেন তিনি।
সোমবার বিকেলে বাড়িটিতে সরেজমিনে গেলে এ প্রতিবেদকও একধরনের কটু গন্ধ পান। যদিও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলোর বাইরে ভাড়াটিয়া সকলের ব্যবহারের জন্য একটি রান্নাঘর রয়েছে। রান্নাঘরে গ্যাসের লাইনটি প্রাথমিকভাবে অক্ষত হিসেবে পাওয়া যায়। এবং যে ঘরটিতে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে ওই ঘরে থাকা ওয়ালটন কোম্পানির রেফ্রিজারেটরটির পেছনের অংশ সম্পূর্ণ পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘরের প্ল্যাস্টিকের তৈরি বৈদ্যুতিক সুইচবোর্ডটিরও একটি অংশ গলে গিয়েছে।
বাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোনের নম্বর কেউ দিতে পারেননি। ঘটনার পর হতাহতদের খবর নিতে হাসপাতালে গেলেও তিনি এলাকাতে আসেননি বলে জানান তাদের স্বজনরা।
বাড়িটির সামনের ওষুধের দোকানের মালিক নূর হোসেন বলেন, “এ বাড়িটিতে গ্যাসের লিকেজ অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। সামনের রাস্তার নিচ থেকে শুরু করে বাড়িটির নিচ দিয়ে তিতাসের একটি বিতরণ লাইন গিয়েছি। ওই লাইনে অনেক আগে থেকেই লিকেজ ছিল কিন্তু তা ঠিকমতো সারানো হয়নি।”
বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন নিহত তাহেরার স্বামী আব্দুর রশীদ। বছর দেড়েক আগে তিনি মারা যান। বর্তমানে বাড়িটির কক্ষগুলোতে ভাড়া থাকেন তারই পরিবার সদস্য ও আত্মীয়রা। ২০১৭ সাল থেকে এ বাড়িতে ভাড়া ছিলেন শাহিদা আক্তার। তিনি তাহেরার ছেলে সজীবের স্ত্রী। বছরখানেক আগে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাওয়ার পর তিনি স্বামীর সঙ্গে চলে যান কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে। শনিবার আগুনের খবর পেয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জে আসেন।
শাহিদা বলেন, “আমরা যখন এই বাড়িতে ছিলাম তখন ঘরের সামনের পাকা জায়গার বিভিন্ন অংশে ফাঁটা ছিল। সেইখানে পানি জমলেই গ্যাসের বুদবুদ দেখতাম। তখন ওইখানে আবার সিমেন্টের লেপ (প্রলেপ) দেওয়া হইছিল।”
যদিও যোগাযোগ করা হলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক বিপনন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ বলেন, বাড়িটির গ্যাস লাইনটি বৈধ সংযোগ। রোববার ও সোমবার দুইদিন তারা এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন।
পরিদর্শনকালে সেখানে গ্যাসের লাইনের কোনো লিকেজ তারা পাননি বলে দাবি করেন।
“আমরা রাইজার বা লাইনের কোথাও লিকেজ পাইনি। পানি জমা জায়গাতে ন্যাচারালি গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করেও সেখানে ন্যূনতম কোনো গ্যাস ডিটেক্ট হয়নি। আর কোনো বিতরণ লাইন বাড়ির নিচ দিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই।”
এদিকে, এখন পর্যন্ত ‘ঘরটিতে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের আলামত’ পাওয়া না গেলেও বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার আভাস দিয়েছেন আদমজী ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা মিরন মিয়া। তিনি বলেন, “আমরা আজ (সোমবার) সকালেও গিয়েছিলাম। কিন্তু দরজা খোলে নাই কেউ। ভিতরে ঢুকে দেখার মতো সুযোগ হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন স্যারদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। এটি নিয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “পাবলিক গ্যাস বললেও তদন্ত ছাড়া আমরা গ্যাসের কথা সরাসরি বলতে পারি না। শুরুর দিনই আমরা ফ্রিজটির কম্প্রেসার ও পেছনের পুরো অংশ পোড়া পাই। তাছাড়া, ঘরটিতে টিনের বিভিন্ন অংশে ফাঁকা থাকায় সেখানে গ্যাস জমার সুযোগ কম। কেননা অন্তত ১২ পার্সেন্ট গ্যাস না জমলে সেখানে থেকে আগুন ধরে না। গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের পর যে ধরনের বিষয় দেখা যায় ঘরটিতে তেমন কিছু পাইনি। তারপরও বিষয়টি তদন্ত টিম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখবে।”
সোমবার এলাকাটি পুনরায় পরিদর্শনে গেলে এলাকাবাসীর ক্ষোভের মুখেও পড়েন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। সরকারি এ সংস্থাটি ঘটনাটির কারণ ‘গ্যাস বিস্ফোরণ’ না বলাতে ক্ষোভও প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। তারা এই ঘটনার সঠিক তদন্তের দাবিতে একটি মানববন্ধনেরও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যদিও দগ্ধদের একজনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তারা এ কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে, বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের একটি দলও বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। কথা হলে নাসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মোহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী বলেন, বাড়িটি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় হওয়াতে স্বপ্রণোদিত হয়ে তারা জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। বিষয়টি আরও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পর্যালোচনার পর মন্তব্য করবেন তিনি।
ঘটনাস্থলে তিনি এবং তার দল বাড়িটিতে থাকাবস্থায় এক ধরনের ‘কটু গন্ধ’ পেয়েছেন, কিন্তু সেটি গ্যাসের কিনা তা নিশ্চিত নন বলেও জানান।
তবে, আগুনের এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে জানান সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীনূর আলম। তিনি বলেন, “হতাহতের পরিবারেরা চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত। তাই তারা এখনো থানায় আসেননি। কিন্তু বিষয়টি অবজারভেশনে রেখেছে পুলিশ।”