কাগজেই সীমাবদ্ধ ‘শহীদ রিয়া গোপ ক্রিকেট স্টেডিয়াম’র নামকরণ

গত বছরের জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজ বাসার ছাদে খেলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ৬ বছর বয়সী রিয়া গোপ। গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এই শিশুর স্মৃতিতে নারায়ণগঞ্জের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামটি নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ রিয়া গোপ ক্রিকেট স্টেডিয়াম’ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
গত ২৩ মার্চ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
তবে, রাজধানীর পাশে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক লাগোয়া এ ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির নাম পরিবর্তনের ঘোষণার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন নামে স্টেডিয়ামটি চিহ্নিত হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পরিবর্তন হয়নি মূল নামফলক, এমনকি লাগানো হয়নি নতুন কোনো সাইনবোর্ডও।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘোষণার পর কর্তৃপক্ষের আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ফলে পুরনো নামেই পরিচিত রয়ে গেছে স্টেডিয়ামটি।
যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে এবং কাজও চলছে। এ বিষয়ে ক্রীড়া পরিষদে চিঠি দেওয়ার কথাও জানা গেছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, অন্তত তিন দশক আগে ঢাকার অদূরে আন্তর্জাতিক মানের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ‘ওসমানী স্টেডিয়াম-২’ নামে এই স্টেডিয়ামের জন্য প্রকল্প বরাদ্দ পায়। তবে, কাজ শুরুর আগেই ক্ষমতার পর পরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তিত হয়। ওই সময় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলীর নামে স্টেডিয়ামটির নামকরণ করা হয়। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শেষদিকে স্টেডিয়ামটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুরুতে স্টেডিয়ামটি ইসদাইরের ওসমানী পৌর স্টেডিয়ামের আশেপাশে নির্মাণের কথা ছিল। যদিও পরে ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় এবং পরে ফতুল্লার রামারবাগ এলাকায় ২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই সময় স্টেডিয়ামটি নির্মাণের জন্য দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দে। যদিও সহ-ঠিকাদার হিসেবে কাজটি করেন ওই সময়ের দাপুটে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। এমনকি নামকরণ করিয়ে নেন নিজের দাদার নামে।
শামীম ওসমানের দাদা মোহাম্মদ ওসমান আলী ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মুসলিম লীগের নারায়ণগঞ্জ শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে খান সাহেব উপাধি দেয়। দাপ্তরিকভাবে স্টেডিয়ামটির নাম ‘খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম’ হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ফতুল্লা স্টেডিয়াম’ বলেই অধিক পরিচিত পায়।
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের কয়েকটি স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তনের তালিকায় ছিল ফতুল্লার এই স্টেডিয়ামটিও। নারায়ণগগঞ্জ শহরের নয়ামাটি এলাকায় শহীদ রিয়া গোপের নাম দেওয়া হয় স্টেডিয়ামটির। কিন্তু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানানোর পর নতুন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সম্প্রতি সরেজমিনে স্টেডিয়ামটি ঘুরে নতুন নামের কোনো সাইনবোর্ড বা নামফলক চোখে পড়েনি। এমনকি স্টেডিয়ামের দেখভালের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মীও জানান, তারা কেবল শুনেছেন যে স্টেডিয়ামটির নাম পরিবর্তন হয়ে ‘শহীদ রিয়া গোপ ক্রিকেট স্টেডিয়াম’ করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা তারা পাননি।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলে তাদের অধিকাংশই জানালেন, এই স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে তারা কিছু শোনেননি। সাধারণত স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নামফলক কিংবা সাইনবোর্ডের মাধ্যমেই চোখে পড়ে, কিন্তু গত কয়েকমাসে তারা এমনকিছু দেখেননি বলেও জানান।
ব্যাট-প্যাড হাতে স্থানীয় তরুণ আরিয়ান মাহমুদ শান্ত স্টেডিয়ামটির ‘আউটার’ অংশে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার জন্য যাচ্ছিলেন। কথা হলে শান্ত বলেন, “আমি এই এলাকারই ছেলে। প্রায় প্রতিদিনই এই আউটার স্টেডিয়ামে খেলি। কিন্তু এলাকার ছেলে হয়েও আমি নিজেই জানি না স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন হয়েছে, বাইরের লোক কীভাবে জানবে।”
“নাম পরিবর্তন করলে সাইনবোর্ড তো অন্তত লাগাতে হয়। নইলে কেউ জানতে কীভাবে। এই মাঠের নাম খান সাহেব ওসমান আলীর নামে জানি, কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ফতুল্লা স্টেডিয়ামই বলি”, যোগ করেন তিনি।
কথা হলে স্টেডিয়ামের দেখভালের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, “নাম পরিবর্তনের বিষয়ে মিডিয়াতে শুনেছি। আমাদের এখনও অফিসিয়ালি নামফলক কিংবা সাইনবোর্ড লাগানোর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এইটা কবে লাগানো হবে সে বিষয়ে ভালো বলতে পারবে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কিংবা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের লোকজন।”
তবে, সাইনবোর্ড বা নামফলক স্থাপনের বিষয়ে একটি চিঠি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা।
যোগাযোগ করা হলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, “ফতুল্লা স্টেডিয়াম ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম, যার নাম পরিবর্তন করে শহীদ রিয়া গোপ ক্রিকেট স্টেডিয়াম নামকরণ করা হয়েছে। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে থেকে জানানো হয়েছে। আমরা স্টেডিয়ামের সামনে একটি সাইনবোর্ড দিয়ে দিবো, যাতে সাধারণ মানুষ জানতে পারে। এবং নাম পরিবর্তন যে হয়েছে তা জানানোর জন্য সবগুলো মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”