২৩ জুন ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২২ জুন ২০২৫

আপডেট: ২১:১১, ২২ জুন ২০২৫

বন্দরে একরাতে দুই খুনের নেপথ্যে

বন্দরে একরাতে দুই খুনের নেপথ্যে

দুইদিন ধরে অস্ত্রের মহড়া, সংঘর্ষ। এরপর একরাতে দুই খুন। এক সময়ে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা থাকলেও বিএনপি সমর্থিত দু’টি পক্ষের মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রাণ গেল বৃদ্ধ এক রাজমিস্ত্রি ও এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার।

শনিবার (২১ জুন) রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার বন্দর রেললাইন ও পাশের শাহী মসজিদ এলাকায় সংঘটিত দু’টি হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় লোকজন, নিহতদের স্বজন ও পুলিশ বলছে, সংঘর্ষের মূল কারণ মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত কয়েকমাসের চলমান দ্বন্দ্ব।

এই ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিরা হলেন: উপজেলার হাফেজীবাগ এলাকার আব্দুল কুদ্দুস (৭০), যিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের বন্দর থানা শাখার সাবেক যুগ্ম আহবায়ক শাহী মসজিদ এলাকার মেহেদী হাসান (৪২)।

স্থানীয়রা বলছেন, দু’জনের কারও মধ্যে আগে কোনো শত্রুতা না থাকলেও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে প্রাণ হারিয়েছেন তারা।

পুরনো বন্ধু, নতুন শত্রুতা
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এই দ্বন্দ্বের শুরু গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। এক সময় রাজনীতির মাঠে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দুই সাবেক কাউন্সিলর, বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা হান্নান সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবুল কাউসার আশার অনুসারীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এক সময়ের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ভেঙে পড়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা ও চাঁদা আদায়ের মতো ইস্যুতে।

একপক্ষে ছিলেন রনি ও জাফর, যাঁরা কাউসার আশার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। অন্যপক্ষে মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে ‘জুয়ারি বাবু’ ও শ্যামল, যাঁরা হান্নান সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে জানান স্থানীয়রা। যদিও ব্যক্তিগতভাবে হান্নান সরকার ও আবুল কাউসার আশার মধ্যে সখ্যতা রয়েছে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি ও নিহতের স্বজনরা বলেন, কয়েকদিন আগে চুরির টিন বিক্রি নিয়ে মুখোমুখি হয় এই দুই গ্রুপ। উভয়পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক ও অস্ত্রের মহড়াও চলে। এরই জেরে শুক্রবার সংঘর্ষে অন্তত আটজন আহত হন। উত্তেজনা গড়ায় শনিবার পর্যন্ত। যা পরে দুই খুনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

শনিবার সন্ধ্যায় বন্দর রেললাইন এলাকায় হামলার শিকার হন রাজমিস্ত্রি আব্দুল কুদ্দুস। স্থানীয় লোকজন বলছেন, রনি-জাফর গ্রæপের লোকজনের সঙ্গে কুদ্দুসের ছেলে পারভেজের সখ্যতা রয়েছে। সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষের লোকজন পারভেজকে খুঁজতে এসে না পেয়ে দোকানে বসে থাকা কুদ্দুসকে টেনে নিয়ে রাস্তায় ধারালো অস্ত্র বেশ কয়েকটি আঘাত করে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

“ভাই চায়ের দোকানে ছিল। পারভেজ কোথায়, তা জানতে চেয়ে ভাইরে মারতে থাকে। ভাই বারবার কইছে, ‘আমার দোষ নাই’, কিন্তু শোনে নাই কেউ,” বলেন নিহতের ছোটভাই দুদু মিয়া।

কুদ্দুসের মৃত্যুর পর পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহতের বিক্ষুব্দ স্বজনরা মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কও অবরোধ করে। অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়। কিন্তু ওই রাতেই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী হাসানকে সড়কের উপর পেয়ে যান প্রতিপক্ষের লোকজন। তারা তাকে তুলে নিয়ে স্থানীয় একটি ক্লাবে নিয়ে বেধরক মারধর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন।

একরাতেই আধিপত্যের দ্বন্দ্বে দুইপক্ষের দুইজন মারা যান।

মেহেদীর বোনের স্বামী মাহফুজুল হক সৌরভ বলেন, প্রথম হত্যার ঘটনার সময় মেহেদী বাড়িতে ছিল। সে ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি সৌরভের।

“কিন্তু প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে রাস্তায় পেয়ে তুলে নিয়ে যায়, এবং সিরাজউদ্দৌলা ক্লাবের সামনে বেধড়ক মারধর করে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।”

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা বলেন, “রনি ও মেহেদী একসময় ভাইয়ের মতো ছিল। ছাত্রদলের রাজনীতির সময় একসঙ্গে জেলও খেটেছে। গত ছয় মাসে কিশোর গ্যাং ও মাদক নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়।”

তিনি দাবি করেন, “এই ঘটনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। দুজনই হান্নান সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল। এমনকি হান্নান কাকার সঙ্গেও আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। রাজনৈতিক কারণে আমাকে এদিকে টেনে আনা হচ্ছে। বিষয়টি পুরোপুরি আধিপত্যের দ্বন্দ্বের, রাজনৈতিক কোনো দ্বন্দ্ব না।”

যদিও হান্নান সরকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুলিশ কী বলছে
গতরাতের ঘটনার পর থেকেই বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ ও রেললাইন এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সকালে সেনাবাহিনীর টহলও দেখা যায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারও।

জেলা পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তাও একরাতে জোড়া খুনের ঘটনাটিকে ‘আধিপত্যের দ্ব›দ্ব’ বলেই উল্লেখ করেন। তবে, এই ঘটনায় জড়িত ও নেপথ্যের কাউকেই ‘ছাড় দেওয়া হবে না’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এসপি বলেন, “স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড দু’টি ঘটেছে। যারা সরাসরি অংশ নিয়েছে এবং যারা নেপথ্যে ছিল, কারো রেহাই নেই। সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে।”

রাতেই র‌্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে তিনজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এই ঘটনায় দু’টি হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “লাশ দাফনের পর নিহতের স্বজনরা থানায় আসবেন বলে জানিয়েছেন। পৃথক দু’টি মামলা হবে। মামলার পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়