১৯ নভেম্বর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৩৭, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে একজোট মনোনয়নবঞ্চিত ৭ বিএনপি নেতা

দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে একজোট মনোনয়নবঞ্চিত ৭ বিএনপি নেতা

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে দলঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন আসনটিতে মনোনয়ন-বঞ্চিত তিন হেভিওয়েট বিএনপি নেতা। তাদের মধ্যে একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আরেকজন সাবেক সংসদ সদস্য। তারা এ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর চিঠিও দিয়েছেন। এ কার্যক্রমে যুক্ত করেছেন মনোনয়ন-বঞ্চিত আরও চারজনকে। বিগত সময়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানা-পোড়েন, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ইতিহাস থাকলেও ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে তারা একজোট হয়ে মাঠে নেমেছেন। পুরোনো হত্যাচেষ্টার ঘটনাও এই জোটবদ্ধতার কাছে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ৩ নভেম্বর সারাদেশে ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। ওইদিন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নানের নাম ঘোষণা করা হয়। মান্নান সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপিরও সভাপতি। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আসনটিতে বিএনপি তাকে ধানের শীষের প্রার্থী করেছিল।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ও সোনারগাঁ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে জাতীয়বাদী দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ওয়ালিউর রহমান আপেল, সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আবু জাফর, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অধ্যাপক ওয়াহিদ বিন ইমতিয়াজ বকুল ও সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আল মুজাহিদ মল্লিক।

মনোনয়ন-বঞ্চিত এ সাত নেতা ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে এলাকায় নেতিবাচক প্রচারণায় ব্যস্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। দলীয় প্রার্থীকে জনগণের সামনে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করায় বরং দলই ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও অভিযোগ তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার পর বিএনপির প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নান মনোনয়ন-বঞ্চিত অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এগোনোর প্রয়াস চালিয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে গিয়াসউদ্দিন ও মামুন মাহমুদের সঙ্গে দেখাও করেন তিনি। কিন্তু তাতে নিভৃত না হয়ে বরং প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। এমনকি মান্নানের বিরুদ্ধে অনুসারী নেতা-কর্মীদের দিয়ে গত মঙ্গলবার সিদ্ধিরগঞ্জে বিক্ষোভ কর্মসূচিও করিয়েছেন।

একইরাতে বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমের রাজধানীর বনানীর বাসায় বৈঠকে বসেন ওই নেতারা। বৈঠক শেষে তারা মান্নানের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্রেও স্বাক্ষর করেন। পরে সেটি পাঠান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলটির শীর্ষ নেতাদের কাছে।

এদিকে, কেন্দ্র ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া অভিযোগে দলটির সাত নেতা ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ তোলেন। আসনটিতে ধানের শীষের আজহারুল ইসলাম মান্নানের চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীও অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন বলেও ইঙ্গিত করেন তারা।

লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, “সোনারগাঁ একটি ঐতিহাসিক এবং সিদ্ধিরগঞ্জ একটি শিল্পসমৃদ্ধ বাণিজ্যিক এলাকা। এ নির্বাচনী এলাকার মানুষের প্রত্যাশা শিক্ষিত, অভিজ্ঞ এবং যোগ্য যে কোন ব্যক্তি যাতে বিএনপি দলীয় এমপি হয়ে সংসদে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রাথমিকভাবে দলীয় মনোনয়ন আজহারুল ইসলাম মান্নানকে দেওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ হতাশ হয়েছে এবং এই মনোনয়ন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দল তাদের দলীয় প্রার্থী যাকে দিয়েছে সে স্থানীয় সুনামধন্য কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পিন্সিপাল ড. মো. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়া...কিন্তু আজহারুল ইসলাম মান্নানের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই।”

মান্নানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের পুনর্বাসন এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানেরও অভিযোগ করেন রেজাউল করিম, গিয়াসউদ্দিন ও অন্যরা।

তারা আসনটিতে মান্নানের পরিবের্ত তাদের মধ্য কাউকে ধানের শীষের প্রার্থী করারও দাবি জানান।

তবে, স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, কয়েকদিন আগেও গিয়াসউদ্দিন ও মামুন মাহমুদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব ছিল। এমনকি একে-অপরের বিরুদ্ধে ছুরিকাঘাতের হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনারও অভিযোগও তোলেন। গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের দু’জনের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। কিন্তু তারা এখন ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাট্টা। মনোনয়ন-বঞ্চিতদের এই জোটবদ্ধ কার্যক্রম ক্ষতি করছে দলকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে রাজধানীর পল্টনে কস্তুরী হোটেলের সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে আহত হন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ। সোনারগাঁয়ের ফজলুল হক মহিলা ডিগ্রি কলেজের এ শিক্ষক ওই সময় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় মামুন মাহমুদকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার অভিযোগ তোলা হয় গিয়াসউদ্দিনের ছেলে গোলাম কায়সার রিফাতের বিরুদ্ধে। পল্টন থানা করা মামলায় তাকে আসামিও করা হয়। হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হন তার ঘনিষ্ঠ ছাত্রদল নেতা সাগর সিদ্দিকীও। পরে রিফাতসহ গিয়াসউদ্দিনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ।

যদিও গিয়াসউদ্দিন ও তার পরিবারের লোকজন অভিযোগ অস্বীকার করে আসেন। কিন্তু মামুন মাহমুদ ও গিয়াসউদ্দিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তখন আরও প্রকট হতে থাকে। তাছাড়া, সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির রাজনীতিতে একক নিয়ন্ত্রণ রাখার দ্বন্দ্বেও বিভক্তি ছিল তাদের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু তারা এখন সেসব বিভেদ ভুলে গিয়ে একাট্টা হয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এতে যুক্ত করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমসহ আরও কয়েকজনকে।

স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ নতুন নয়, কিন্তু এবার মনোনয়ন-বঞ্চিত হেভিওয়েট নেতাদের সমন্বিত অবস্থান দলটির জন্য বড় চাপ তৈরি করেছে। বহু বছরের দ্বন্দ্ব, এমনকি অতীতের হত্যাচেষ্টা-সংক্রান্ত অভিযোগও পাশ কাটিয়ে তারা একজোট হয়েছেন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এতে স্পষ্ট হয়েছে- দলের স্বার্থের চেয়ে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ এখানে গুরুত্ব বহন করছে। ধানের শীষের ঘোষিত প্রার্থীকে ঘিরে নেতিবাচক প্রচারণা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে মাঠপর্যায়ে বিভ্রান্তি বাড়ছে, যা নির্বাচনী মাঠে বিএনপির ঐক্য ও সংগঠনীক শক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়