২২ আগস্ট ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২২:০৭, ২১ আগস্ট ২০২৫

অতিরিক্ত বাসভাড়ার অর্ধকোটি টাকা যাবে কার পকেটে?

অতিরিক্ত বাসভাড়ার অর্ধকোটি টাকা যাবে কার পকেটে?

আন্দোলনের মুখে বাসভাড়া কমানোর সিদ্ধান্তের এক বছর না যেতেই আবারও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে নন-এসি বাসের ভাড়া ৫ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। তবে, বর্ধিত এ ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন মহল থেকে আন্দোলনের নামার ঘোষণা এসেছে।

এদিকে এক হিসেবে দেখা গেছে, ৫ টাকা বাসভাড়া বাড়ানোর ফলে মাসে অন্তত ৫৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হবে যাত্রীদের কাছ থেকে। তীব্র বিরোধীতার সত্ত্বেও ভাড়া বাড়ানোর পর অতিরিক্ত এই অর্ধকোটি টাকা কার পকেটে যাবে, এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

বুধবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির সভায় রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতাদের বিরোধীতার পরও বাসভাড়া ৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এ রুটে বর্ধিত বাসভাড়া কার্যকর হবে।

পরিবহন মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আগে কয়েকটি পরিবহনের বাস চলাচল করলেও বর্তমানে সিটি বন্ধন পরিবহন ও উৎসব ট্রান্সপোর্টের শতাধিক বাস চলাচল করে। এ রুটে ৪৫ টাকায় নন-এসি বাসগুলোতে যাত্রী পরিবহন করলেও করোনাকালীন সময়ে বাসভাড়া একলাফে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়। পরে তা ৫ টাকা কমিয়ে ৫৫ টাকা করা হয়।

গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জে বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে নারায়ণগঞ্জ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। তারা অর্ধবেলা হরতালেরও ঘোষণা দেন। পরে হরতালের একদিন আগে ১৬ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বাস-মালিক ও যাত্রী অধিকার ফোরামের সঙ্গে বৈঠক করে বাসভাড়া কমিয়ে ৫০ টাকা নির্ধারণ করেন।

এই সিদ্ধান্তের ৯ মাসের মাথায় বাসভাড়া পুনরায় বাড়ানোর ঘোষণা ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক, নাগরিক, ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতা। তারা বলছেন, জ্বালানির মূল্য কিংবা দূরত্ব বৃদ্ধি না পেলেও হঠাৎ করে বাসভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে অন্যায়ের শামিল।

একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে উৎসব ট্রান্সপোর্টের ৪৫টি এবং বন্ধন পরিবহনের ৫৮টি বাস চলাচল করে। বাস-মালিকদের তথ্য অনুযায়ী হিসেব করলেও প্রতিটি বাসে ৪৫টি করে আসন রয়েছে। একটি বাস দিনে অন্তত চারটি ট্রিপ (একবার যাওয়া ও আসা) দিতে পারেন। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ট্রিপের সংখ্যা আরও বাড়ে।

চারটি ট্রিপ হিসেব করলেও নতুন ভাড়া নির্ধারণের হিসেবে মাসে অন্তত ৫৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হবে যাত্রীদের কাছ থেকে। যদিও এই অতিরিক্ত ভাড়ার টাকা মালিকের পকেটে না গিয়ে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

স্থানীয় সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পরিবহন খাত ছিল ওসমান পরিবারের দখলে। ওসমান পরিবারের সদস্যরা পরিবহন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতেন। বাস-মালিকরা একরকম বাধ্যই হতেন তাদের চাঁদা দিতে। ২০১১ সালে মালিকরা অতিষ্ঠ হয়ে র‌্যাবের কাছে দেওয়া এক লিখিত অভিযোগে ওসমান পরিবারের কার কাছে কত টাকা চাঁদা দেন তা সবিস্তারে উল্লেখ করেছিলেন। তখন নারায়ণগঞ্জে এই পরিবহন চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এমনকি হরতালের মতো কর্মসূচিও গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। যদিও পরিবহনে এই চাঁদাবাজি থামানো যায়নি।

ওই সময় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন সারাহ বেগম কবরী। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভাতে পরিবহন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে তেড়েও যান সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলায় নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রফিউর রাব্বির প্রতিও তীব্র ক্ষোভ ছিল শামীম ওসমানের।

রাব্বির ছেলে মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাব এক সংবাদ সম্মেলনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওসমান পরিবারের জড়িত থাকার তথ্য তুলে ধরে। ওই সময় র‌্যাব জানায়, ত্বকী হত্যার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল এই পরিবহন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা।
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে শহর ছেড়ে পালান ওসমান পরিবারের সদস্যরা। এ পরিবারের অন্যতম সদস্য একেএম শামীম ওসমান, যিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের চারবারের সংসদ সদস্য ছিলেন, তিনিও তার পরিবারসহ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তার অনুসারী নেতারাও অনেকে দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে আছেন।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় ‘চাঁদাবাজমুক্ত পরিবহন খাতে’ নৈরাজ্য কমানো এবং যাত্রী সাধারণকে স্বস্তি দিতে আবারও আন্দোলন গড়ে তোলে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। তাদের আন্দোলনের মুখে বাসভাড়া কমানো হলেও হঠাৎ করে এক সভার মধ্য দিয়ে বাসভাড়া ৫ টাকা বাড়ানোয় প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

অভিযোগ উঠেছে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় পরিবহন খাতে নতুন করে ‘চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে। অনেকে প্রশাসনের দিকেও আঙুল তুলেছেন। প্রশাসনের কাছেও চাঁদার ভাগ যায় কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে ‘নারায়ণগঞ্জের ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরাও এ প্রশ্ন তুলে বাসভাড়া আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে কমানো না হলে শহরে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেন।

এদিকে, একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতারা পরিবহন খাত দখলের চেষ্টা করছেন। পরিবহন দখল নিয়ে গত কয়েকমাসে একাধিক সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে বন্ধন পরিবহনের দখল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হন। ওই সময় গুলির ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয় পুরোনো অনেক চাঁদাবাজ কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে যোগসাজশ করে নতুন করে পরিবহন খাত দখলের চেষ্টায় রয়েছেন।

যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, “আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সেক্টরের মতো এই পরিবহন খাতটি ছিল ওসমান পরিবারের চাঁদাবাজির অন্যতম উৎস। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বৃদ্ধি করে জনগণের দুর্ভোগ তৈরিতে স্থানীয় বিআরটিএ ও প্রশাসন সব সময় তাদের সহায়তা করেছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন সিন্ডিকেট মাফিয়া ও গডফাদারদের কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন, কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা চাই না পরিবহন সেক্টর আবার কোনো চাঁদাবাজ ও গডফাদারের হাতে বন্দী হয়ে না পড়ে।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়