বাস ভাড়া বৃদ্ধিতে ক্ষোভে ফুঁসছে নারায়ণগঞ্জবাসী

আন্দোলনের মুখে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া কমানোর বছর না যেতেই জেলা প্রশাসন ফের টিকেট প্রতি ভাড়া ৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে। জ্বালানির দাম কিংবা দূরত্ব না বাড়লেও ভাড়া বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নগরীর রাজনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক ও পেশাজাবী সংগঠনের নেতারা।
বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির সভায় রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতাদের বিরোধীতার পরও বাসভাড়া ৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেন ডিসি জাহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এ রুটে বর্ধিত বাসভাড়া কার্যকর হবে।
অভিযোগ উঠেছে, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় পরিবহন খাতে নতুন করে ‘চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
তবে, নগরবাসী চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি থাকতে নারাজ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই অতিরিক্ত বাসভাড়ার বিরুদ্ধে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যস্ত করেছেন অনেকে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা। অনেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকেও বাসভাড়া বৃদ্ধির নেপথ্যের কারিগর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সকাল থেকে বর্ধিত মূল্যে টিকেট বিক্রি শুরু হয়। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে হঠাৎ ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে পেরে সাধারণ যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই টিকেটের ছবি তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গত বছর জুলাই আন্দোলনের পর নগরবাসীর ব্যাপক অংশগ্রহণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রধান দাবি ছিল, চাঁদাবাজদের চাঁদা না দিয়ে ভাড়া কমানো। ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও কর্মসূচির ফলে গত বছরের নভেম্বর মাসে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক টিকেট প্রতি ৫ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নির্ধারণ করেন। এ বিষয়ে সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছিল।
বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বুধবার এক সভা আহ্বান করে ৫ টাকা ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। সভায় রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়, কিন্তু প্রশাসন সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
এর প্রতিবাদ জানিয়ে যাত্রী অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, “জেলা প্রশাসকের যেই ভূমিকা তা আমরা ন্যাক্কারজনক মনে করি। আমরা কয়েক মাস আগে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছিলাম এসি বাসের ভাড়া কমানোর জন্য, যখন ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ করল তখন। সে এটাকে কোনও গুরুত্ব দিল না, আর বাস মালিকরা যখন পরশুদিন তাঁকে চিঠি দিয়ে বললো ভাড়া বাড়াতে হবে, তিনি জরুরি ভিত্তিতে সবাইকে ডেকে নিয়ে ৫ টাকা ভাড়া বাড়ায় দিলো। এই ভূমিকটা জনবিরোধী এবং বাস মালিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এ সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।”
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম আগামী শনিবার নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও ডেকেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, “বাস ভাড়া বৃদ্ধি নারায়ণগঞ্জের মানুষকে হতাশ করেছে। এই অনৈতিক ভাড়া বৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস ভাড়া ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করার সিদ্ধান্তকে গণস্বার্থবিরোধী ও অযৌক্তিক বলে দাবি করে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী, ক্রীড়া অনুরাগী ও ব্যবসায়ী মাসুদুজ্জামান মাসুদ বলেন, “গত এক বছরে জ্বালানির দামও বাড়েনি। সুতরাং এই সময়ে ভাড়া বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং গণবিরোধী। যদি এর সঙ্গে কোনো চাঁদাবাজীর সংশ্লিষ্টতা থাকে তবে তা দ্রুত জনগণের কাছে প্রকাশ করার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।”
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব বলেন, “কোন কারন ছাড়াই ৫ টাকা বাস ভাড়া বৃদ্ধি মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নেই।”
ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক দাবি করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলন। দলটির জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন এক বিৃবতিতে বলেন, “বাস মালিকদের অন্যায্য দাবির প্রতি প্রশাসনের নতি শিকার এবং যাত্রী সাধারণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে। শহরে যানজট, চাঁদাবাজি, দখলসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারায় নগরবাসীর মধ্য অসন্তোষ রয়েছে। এই বাস ভাড়া বৃদ্ধি প্রশাসনের প্রতি মানুষের অনাস্থা বৃদ্ধি করবে। এবং জেলা প্রশাসকের ইতিবাচক কাজ গুরুত্ব হারাবে বলে আমি আশঙ্কা করি।”
ওয়ার্কিং ফর বেটার নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক ও নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, “জ্বালানি মূল্যের স্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও বাস ভাড়া অযথা বৃদ্ধি করা হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হবে। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা ও নিম্ন-আয়ের মানুষজন প্রতিনিয়ত পড়াশোনা ও কর্মস্থল পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য এই ভ্রমণ পরিসর ব্যবহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।”
ইসলামী আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, “আমরা গতকাল (বুধবার) মিটিং চলাকালীনও বাসভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বিরোধীতা করেছি। আমরা বাসভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখিনি। কিন্তু বিরোধীতা থাকা সত্ত্বেও একচেটিয়াভাবে বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
“বাস-মালিকদের দাবি অনুযায়ী এখন যেহেতু কোনো চাঁদাবাজি হয় না, তাহলে বাসভাড়া বাড়ানোর তো কোনো কারণ নেই। আমরা বাসভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদ জানাই। এবং একইসাথে এই ভাড়া প্রত্যাহারের জন্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।”
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টি এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস ভাড়া সরল অংক। ন্যায্য ভাড়া ৫০ টাকা, চাঁদাবাজের ৫ টাকা, সমান ৫৫ টাকা। ৫ আগস্টের চাঁদাবাজ না থাকায় ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। নতুন চাঁদাবাজের কারণে ভাড়া আবার ৫৫ টাকা। প্রকৃতি শূণ্যস্থান পছন্দ করেন না।”
“বাস মালিকদের পক্ষে কথা বলতেসে বিএনপি জামাতের নেতারা, ডিসি দেখায় আইনের দোহাই। এতদিন কি তাহলে বেআইনিভাবে চলছে? আমরা এর আগেও দাবি তুলেছিলাম যে, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এর দূরত্ব মেপে তেলের বর্তমান দাম অনুযায়ী ভাড়া ঠিক করতে। এবং সেখানে আমাদের দাবি ছিল ৪৫ টাকা। সেইটা করলেও মালিকদের মুনাফা থাকত। তাও আগের ডিসি ৫০ টাকা করায় মেনে নিয়েছিল সবাই”, লিখেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক শওকত আলী।
‘আজকে আবার নতুন কিছু হয়েছে? তেলের দাম বেড়েছে? নাকি ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এর দূরত্ব বেড়েছে? তাহলে হঠাৎ ভাড়া বৃদ্ধির পায়তারা কেন’ এ প্রশ্ন তুলে সকলকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এক ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জবাসীকে জিম্মি করে রেখেছিল। আমরা আর কোন রাজনৈতিক দল, নেতা বা আমলাদের কাছে, পরিবহন মাফিয়াদের কাছে জিম্মি থাকতে চাই না!”
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, “এটা একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত, আমরা এটি প্রত্যাখ্যান করছি। কোনো খচর বৃদ্ধি ছাড়াই ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাস মালিকরা বলছে, যাত্রী সুবিধার্থে বাসকে ৫২ থেকে ৪৫ সিটে নিয়ে আসায় তাদের লোকসান হচ্ছে। যা যাত্রীদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। বুধবার এক সভা ঢেকে জোড়পূর্বক বাসভাড়া বৃদ্ধি করে।”
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের মহানগর সাধারণ সম্পাদক অমিত হাসান বলেন, “ওসমান পরিবারের চাঁদাবাজির বলয় থেকে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন মুক্ত হওয়ার পর আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন ও বাস মালিক সমিতি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রূটের ভাড়া ৫ টাকা কমিয়ে ৫০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের হাফপাস কার্যকর করে। কিন্তু বছর ঘুরতেই আবারও ৫ টাকা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একটি নেক্কারজনক ঘটনা বলে মনে করছি। অথচ জ্বালানির দাম বাড়েনি। তাহলে কোন অজুহাতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত! তবে কি, পরিবহনে আবার নতুন সিন্ডিকেট এর কালো হাত পড়লো?”