এইচএসসি: যে কারণে ২৫ পরীক্ষার্থীর কেউই পাস করেনি

এ বছর নারায়ণগঞ্জে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জেলার গড় পাসের হার নেমে এসেছে ৫৩ শতাংশে, যা গত বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে দাঁড়িয়েছে ৩২১ জনে, যেখানে গত বছর ছিল ৯৪৫ জন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়- রূপগঞ্জ ও বন্দর উপজেলার তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউই পাস করতে পারেনি।
রূপগঞ্জ উপজেলার নব কিশলয় হাই স্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের ২৫ জন পরীক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকে ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছেন এবং অর্ধেক আবার ইংরেজির পাশাপাশি আইসিটি বিষয়েও অকৃতকার্য হয়েছেন।
একই উপজেলার আব্দুল আজিজ মিয়া আয়েশা খাতুন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একমাত্র শিক্ষার্থীও ফেল করেছেন।
বন্দর উপজেলায় অবস্থিত আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকেশ্বরী মিলস স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনজনই অকৃতকার্য হয়েছেন।
শতভাগ অকৃতকার্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেবল নব কিশলয় এমপিও-ভুক্ত।
সরেজমিন নব কিশলয় কলেজ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে অবস্থিত। কয়েক দশক পূর্বে নদী ভাঙন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাস্তুহারা মানুষজনকে এখানে পুনর্বাসন করা হয়। তিনদিকে নদীবেষ্টিত জনবহুল এ অঞ্চলটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সারাদেশে আলোচিত আগে থেকেই। এখানে বাসিন্দারা অনেকে আর্থিকভাবেও খুব একটা স্বচ্ছল নন।
কায়েতপাড়া ইউনিয়নের এই এলাকায় ১৯৭৫ সালে প্রাথমিকের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকও যুক্ত হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বালক ও বালিকা উভয় শাখা থাকলেও কলেজটি কেবল বালিকাদের জন্য। তিন বিভাগের জন্যই আলাদা ভবন রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। যার মধ্যে একটি পাঁচতলা এবং অপর দু’টি চারতলা। এছাড়া, চারতলার একটি প্রশাসনিক ভবনও রয়েছে। সেখানে কথা হয় অবকাঠামোগতভাবে উন্নত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে।
তারা জানান, ২০১৪ সালে মাধ্যমিকের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকের শাখা যুক্ত করা হবার পর থেকেই কখনই এমন বাজে ফলাফল দেখেননি তারা। বরং বিগত বছরগুলোতে খুব ভালো ফলাফল ছিল। ২০২২ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেন এবং তিনজন জিপিএ-৫ পান। পরের দু’বছরও পাসের হার ছিল ৬৫ শতাংশের উপরে।
তবে, এ বছর কেন সব শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য এবং সকলেই ইংরেজি বিষয়ে- এ প্রশ্নের জবাবে নব কিশলয় হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আয়েশা আক্তার জানালেন, প্রতিষ্ঠানটিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি শিক্ষকই নেই। মাধ্যমিকের শিক্ষকই ‘প্রক্সি’ দিয়েছেন এতগুলো বছর। আর গত ছয়মাস মার্তৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলেন আইসিটি’র শিক্ষক।
২০২২ সালের জুলাইতে এমপিও-ভুক্ত হওয়া নব কিশলয় হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অকৃতকার্য সব পরীক্ষার্থীই চনপাড়ার বাসিন্দা। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে আর একটি কলেজ রয়েছে- ডেমরা কলেজ। তবে, সেটি নদী পাড় হয়ে যেতে হয় চনপাড়ার বাসিন্দাদের।
রোববার বেলা এগারোটার দিকে প্রধান ফটক পেরিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষের দিকে এগোতে টিচার্স রুমে শিক্ষকদের বৈঠক দেখা যায়। ওই বৈঠকে ফলাফল বিপর্যয় নিয়েই আলাপ চলছিল বলে পরে জানান প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আয়েশা আক্তার।
তিনি বলেন, “আলোচনা করে কিছু কারণ আমরা আইডেন্টিফাই করেছি। প্রথমত আমাদের ইংরেজি শিক্ষকই নেই। বিগত বছরগুলোতেও ছিল না। মাধ্যমিকের শিক্ষকই উচ্চ মাধ্যমিকে প্রক্সি দিতেন। আর এবারের পরীক্ষার্থীরাও পাঠে অমনোযোগী ছিল।”
এ অঞ্চলে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল লোকজনের বসবাস। শিক্ষার্থীদের প্রায় সকলেই উপবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরীক্ষার্থীদের ১৩ জনই বিবাহিত। চারজন পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশোনার পাশাপাশি বাইরে কাজও করেন। কয়েকজন পর্যাপ্ত বইও কেনেনি। ফলে তাদের অধিকাংশই শ্রেণিকক্ষে গড়হাজির ছিলেন এবং বাকিরা অমনোযোগী ছিলেন বলে জানান এ শিক্ষক।
তবে, শীঘ্রই ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে, ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে শিক্ষা বোর্ডে আবেদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, সকলেই ইংরেজিতে ফেল করার কথা না। তাদের অনেকেই ইংরেজি বিষয়ে খুব ভালো লিখেছিলেন উত্তরপত্রে। উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে বিশ্বাস তাদের।
২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.১৭ পেয়েছিলেন সামিয়া ইসলাম। পরে বিভাগ বদলে মানবিক নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন।
এইচএসসির ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট সামিয়া বলেন, “আমরা কেউই ফেল করার মতো পরীক্ষা দেইনি। আমাদের পার্মানেন্ট ইংরেজি টিচার ছিলেন না। কিন্তু যে শিক্ষক পড়িয়েছেন তাও আমার পর্যাপ্ত মনে হয়েছে। আমার বিশ্বাস, খাতাগুলো ঠিকমতো দেখা হয়নি।”
তবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে প্রশাসনিক অদক্ষতাকে বড় একটি কারণ হিসেবে দেখছেন জেলা শিক্ষা অফিসার আতিকুর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে অবসরের পরেও নজিবর রহমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে প্রভাষক আয়েশা আক্তার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। একজন প্রভাষকের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাওয়ার পেছনেও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা অফিসার আতিকুর বলেন, “দীর্ঘদিন ইংরেজি শিক্ষক না থাকলেও নিয়োগ হয়নি। এটি প্রশাসনিক দুর্বলতা। বর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তিনি একজন প্রভাষক। তার প্রশাসনিক দক্ষতা কম। তিনি সঠিকভাবে শিক্ষকদের গাইড করতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে না। করতে পারার কথাও না।”
আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এডহক কমিটি করা হলে এ নব কিশলয়’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান রূপগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার। কিন্তু ফলাফল বিপর্যয়ের পর এ প্রতিষ্ঠানটিতে নিজে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেবেন বলে জানান আতিকুর।
“শুরুতেই একজন প্রশাসনিক দক্ষতা-সম্পন্ন অধ্যক্ষ এবং চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন তিনি।