নারায়ণগঞ্জ-৪: জামায়াতের সামনে ইতিহাস গড়ার হাতছানি
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন নারায়ণগঞ্জ-৪। রাজধানীর পাশে গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটিতে এখন পর্যন্ত প্রার্থী ঘোষণা করেনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নির্বাচনী জোটের কোনো দলকে আসনটি ছেড়ে দিবে কিনা তাও নিশ্চিত করেনি। ফলে আসনটিতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ছন্নছাড়াভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পুরোদমে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী।
আসনটিতে এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মাঠে রয়েছেন। তবে, প্রচারণায় এবং গণসংযোগে এগিয়ে আছে জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী। ইতোমধ্যে জামায়াত আসনটিতে তাদের প্রার্থীকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বিগত সময়ে কখনোই এ আসনে জামায়াতের কোনো প্রার্থী বিজয়ী না হলেও এবারের হিসেব-নিকেশ এগিয়ে রাখছে তাদেরই।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, এরশাদ সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি সৃষ্টি করা হয়। আগে সদর উপজেলার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা নিয়ে আসনটি গঠিত হলেও চলতি বছর এর সীমানা পুননির্ধারণ করে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। আর যুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে থাকা সদর উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন। আসনটিতে মোট ভোটার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩২৫ জন।
আসনটিতে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী না দিলেও মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু, জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি। এছাড়া, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তারা নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন চাইলেও সেখানে না পেয়ে এ আসনটির জন্য কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন। তবে, দল এখনো কাউকে চূড়ান্ত করেনি।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী আব্দুল জব্বারকে প্রার্থী করেছে। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে জামায়াতের নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির আমীরের দায়িত্বও পালন করছেন।
এ আসনে গণসংহতি আন্দোলন তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাহিদ সুজনকে প্রার্থী করেছে। অন্যদিকে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ইলিয়াস আহমেদ। পেশায় সুতা ব্যবসায়ী ইলিয়াস দলটির নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো চূড়ান্তভাবে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করলেও আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমিন। পেশায় আইনজীবী এ নেতা এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সমন্বয়কারী।
গণঅধিকার পরিষদেরও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এ আসনে আলোচনায় আছেন প্রকৌশলী আরিফ ভূঁইয়া। তিনি দলটির নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির সভাপতি। তবে, তাকে তেমন প্রচারণায় দেখা যায়নি।
তবে, আসনটিতে প্রচারণায় সক্রিয় আছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটে গিয়ে এ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতে ইসলামের আমীর মনির হোসাইন এবারও আসনটিতে নির্বাচনে আগ্রহী। কিন্তু বিএনপি তাদের শরিকদের সঙ্গে কোথায় কোথায় আসন ভাগ করবে তা পরিষ্কার করেনি।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য ও গত কয়েকমাসে দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফতুল্লার পাঁচটি ও সদরের দু’টি ইউনিয়নে প্রচারণামূলক কার্যক্রমে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী আব্দুল জব্বার। তাদের দলীয় প্রতীক দাড়ি-পাল্লার পক্ষে প্রতিদিনই গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন খোদ প্রার্থী এবং দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। সম্প্রতি বিশাল এক মোটর-সাইকেল শোডাউন করেও বিশেষভাবে নজরে এসেছেন আব্দুল জব্বার।
বিএনপি কাউকে আসনটিতে চূড়ান্ত না করলেও বিচ্ছিন্নভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন দলটি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। এ আসনে বিএনপির হেভিওয়েট হিসেবে মোহাম্মদ শাহ আলম থাকলেও দু-একটি কর্মসূচির বাইরে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। মাশুকুল ইসলাম রাজীব, মশিউর রহমান রনি ও শহীদুল ইসলাম টিটুও নিজেদের মতো করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে, তা যতটা না মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের, তারচেয়ে বেশি দলের হাইকমাণ্ডের নজর কাড়ার উদ্দেশ্যে।
স্থানীয় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, রাজপথের রাজনীতি থেকে শাহ আলম নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ব্যবসায় মনোযোগ দিলেও গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও শাহ আলম ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছিলেন। সেবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী সারাহ বেগম কবরী তারচেয়ে মাত্র কয়েক হাজার ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী হবার আশাতেই পুনরায় রাজনৈতিক অঙ্গণে সক্রিয় হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি তার কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও জোরেশোড়ে কোনো প্রচারণায় নেই।
এদিকে, গত ৩ নভেম্বর সারাদেশে ২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার দিন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি, সেসব আসনে আলোচনার মাধ্যমে শরিক দলগুলো থেকে প্রার্থী ঘোষণা হতে পারে। এ আসনে দলীয় প্রার্থী না দেয়ায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, এ আসনে শরিক দল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী মনোনয়ন দেয়া হবে। যেমনটা ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেয়া হয়েছিল। যদিও বিতর্কিত ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান।
শুরুর কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মাঠপর্যায়ে ব্যাপক দৌড়ঝাপ শুরু করলেও বিগত কয়েকদিনে মনির হোসাইন কাসেমীর তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। মূলত সম্প্রতি ‘আজমতে সাহাবা’ শীর্ষক এক সমাবেশের মধ্য দিয়ে নজর কাড়তে চেয়েও ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই তার তৎপরতা কমতে শুরু করে।
গত ১ নভেম্বর শহরের মাসদাইর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে কাসেমী পরিষদ থেকে আজমতে সাহাবা সম্মেলন আয়োজন করা হয়। কিন্তু দিনব্যাপী এই আয়োজন ছিল জন্যশূণ্য। সভায় হেফাজতে ইসলামের আমীরকে অতিথি করা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। তবে এ সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদকে রাখায় বিকেল থেকে বিএনপির কর্মী, সমর্থকরা ভ্যেনুতে আসতে থাকে। যার ফলে আয়োজনের পরের ভাগে ভ্যেনুতে লোকসমাগম দেখা গেলেও অধিকাংশ চেয়ার ছিল ফাঁকা। বিশ্লেষকদের মতে, এদিন বিএনপির নেতাকর্মীরা না গেলে সব চেয়ারই ফাঁকা থাকতো। অনেকে কাসেমীর এই আয়োজনকে ‘ফ্লপ’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল আমিন মাঠপর্যায়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে এলাকার জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু মোকাবেলায় বিভিন্ন উদ্যোগ, নারায়ণগঞ্জকে মেট্রোরেলে যুক্ত করার আন্দোলনসহ নাগরিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে ভোটারদের মধ্যে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। গুঞ্জন রয়েছে এনসিপি বিএনপির সাথে জোটগত ভাবে নির্বাচন করলে এই আসনে জোটের থেকেও মনোনয়ন পেতে পারেন জাতীয় নাগরিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এই নেতা।
এছাড়া, খেলাফত মজলিসের প্রার্থী ইলিয়াস আহমদ নিয়মিত প্রচারণায় থাকলেও গণসংহতি আন্দোলনের জাহিদ সুজন পিছিয়ে আছেন।
বিএনপির মতো বড় দল এ আসনে প্রচারণায় পিছিয়ে থাকায় তুলনামূলক ফাঁকা মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জামায়াতের প্রার্থী আব্দুল জব্বার। রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতেও সক্রিয় আছেন তিনি। সর্বশেষ গত ১৪ মে বিশাল শোডাউন করেও আলোচনায় আসেন তিনি। কয়েক হাজার মোটরসাইকেলের এ শোডাউনে বিলাসবহুল ছাদখোলা প্রাডো গাড়ি নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিজের শক্তি প্রদর্শনও করেন ওইদিন।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংসদ সদস্য হন। গত তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন গডফাদার-খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। তার আগে এ আসনে এমপি ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। ২০০১ সালের নির্বাচনে শামীম ওসমানকে হারিয়ে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত তিন দশকে এ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাই আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং প্রতিবারই সরকারে থাকা দলটির নেতারাই আসনটিতে ক্ষমতায় ছিলেন। বিগত কোনো নির্বাচনেই জামায়াতে ইসলামী এ আসনে বিজয়ী হতে পারেনি। তবে, এবার গণঅভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীই অন্যদের থেকে এগিয়ে। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতারা পলাতক এবং বিএনপিও আসনটি নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করছে না। বিএনপি জোট প্রার্থী দিলে এবং দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী না হলে আব্দুল জব্বারের সামনে অপেক্ষা করছে ইতিহাস গড়ার হাতছানি।





































