শহীদ রিয়া গোপের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী: ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় প্রাণ

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। দুপুরে খাওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার নিজের বাড়ির ছাদে খেলছিল রিয়া। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ শুনে মেয়ে রিয়ার খোঁজ নিতে ছুটে যান বাবা দীপক। ছাদে পৌঁছে কন্যাকে কোলে নিতেই একটি গুলি এসে লাগে রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই বাবার কোলে ঢলে পড়ে রিয়া, দীপকের শরীর ভিজে যায় মেয়ের রক্তে।
অচেতন অবস্থায় রিয়াকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢামেকে অস্ত্রোপচারের দুʼদিন পর ২৪ জুলাই মারা যায় শিশু রিয়া। তার মৃত্যু সনদে লেখা হয়— ‘গানশট ইনজুরি’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শিশু রিয়ার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
মাত্র ছয় বছর বয়সী এই নিষ্পাপ শিশুটি গত বছরের এই দিনে নারায়ণগঞ্জ শহরে চলমান আন্দোলনের মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনো চিহ্নিত হয়নি রিয়ার হত্যাকারীরা।
দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থাকার পর দীপক কুমার গোপ ও বিউটি ঘোষ দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় রিয়া। পরিবারের একমাত্র সন্তান রিয়াই ছিল তাদের সুখ-আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সেই স্নেহের সন্তানকে হারিয়ে আজ এক বছরে ভেঙে পড়েছে গোটা পরিবার। রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বাবা দীপক ও মা বিউটি। মা বিউটি বিছানায় পড়ে যান, বাবা দীপক হন হতাশাগ্রস্ত। তাদের বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ, কাউকে সামনেও আসতে দেন না। প্রতিবেশীরা জানান, আজও প্রতি রাতেই কান্নার শব্দ ভেসে আসে রিয়াদের ঘর থেকে।
শহীদ শিশু রিয়া গোপের মৃত্যুর একবছরেও শনাক্ত হয়নি হত্যাকারীরা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিও ও স্থিরচিত্রে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে এবং এলোপাথারি গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ডিআইটি এলাকার গুলশান সিনেমা হলের সামনে শামীম ওসমান গাড়ি থেকে নামার পর তার অনুসারীরা পুরো সড়ক দখলে নিয়ে গুলি চালাতে থাকে। এ সিনেমা হলের পাশেই রিয়াদের চারতলা ভবন, যার ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় শিশুটি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ওই দিন শহরের চাষাঢ়া থেকে মন্ডলপাড়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর কয়েক দফায় হামলা চালায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর ছোড়া গুলিতে রিয়ার মৃত্যু হয়েছে।
রিয়া গোপের মৃত্যুর পর বহুবার পরিবারকে মামলা করার অনুরোধ করা হলেও তারা রাজি হননি। দীপক কুমার গোপ বলেন, “আমার সন্তান তো আর ফিরে আসবে না। আমি মামলা করে কি করব? যারা করসে, তাদের কি কোনোদিন বিচার হবে?”
অবশেষে রিয়ার মৃত্যুর প্রায় ১১ মাস পর, ২০২৫ সালের ১ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু রায়হান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, “২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দেড়শ থেকে দুইশ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ডিআইটি এলাকায় গুলিবর্ষণ করে। সেই গুলিতে রিয়া গোপ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।”
সরকার ইতোমধ্যে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রিয়া গোপের স্মৃতিকে স্মরণীয় রাখতে নারায়ণগঞ্জের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ রিয়া গোপ ক্রিকেট স্টেডিয়াম’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নাম রিয়া গোপ মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স করা হয়েছে।