১৮ জুলাই: আন্দোলনে উত্তাল নারায়ণগঞ্জ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে

আগের রাত থেকেই শঙ্কা ছিল হামলার। একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া অবস্থান এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলার প্রস্তুতিরও খবর আসছিল আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে। তবুও সকালে ভয়কে জয় করে পঞ্চমদিনের মতো নারায়ণগঞ্জের রাজপথে নেমে এসেছিল কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে টানা চারদিন বাধা ও বিশৃঙ্খলা ছাড়াই আন্দোলন চালাতে পারলেও ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পুলিশি বাধা সংঘর্ষে রূপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুহুর্মুহু গুলি, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সশস্ত্র হামলায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেদিন পুলিশের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা। এই হামলার বিপরীতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা। হাতে থাকা লাঠি, বাঁশ ও ইটের টুকরা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবেলা করতে গিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে হতাহত হতে হয় ওইদিন। তবুও তাদের কণ্ঠে ছিল, ‘বুকের ভেতর ভীষন ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’
ওইদিন সারাদিন কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো শহর, চলছিল মুহুর্মুহু গুলি। এই পরিস্থিতি ছিল রাত পর্যন্তও।
আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা বলেন, চারদিনের আন্দোলনের পর পূর্ব ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রতিরোধ করতে ওইদিন সকাল থেকে শহরের চাষাঢ়া চত্ত্বরে সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শহরে মোতায়েন করা হয়েছিল অতিরিক্তি পুলিশ। খাঁজা মার্কেটের সামনে অবস্থান করছিল জল কামান, সাঁজোয়া যান- এপিসি কার। অন্যদিকে শহরের উত্তর চাষাঢ়া, কলেজ রোড ও খানপুর এলাকায় অবস্থান করছিল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
প্রতিদিনের মতো ওইদিন সকাল ১০টা থেকে চাষাঢ়ার আশেপাশে বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হতে থাকে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থানের কারণে চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জড়ো হতে পারছিল না তারা। বেলা ১১টায় জেলার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। মাইকিং করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির পক্ষে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বঙ্গবন্ধু সড়কে মিছিল বের করে দুই নম্বর রেলগেট, মন্ডলপাড়া এলাকা প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চাষাঢ়া চত্ত্বরে এসে অবস্থান নেয়।
এদিকে ওই সময় শহরের মিশনাপাড়া এলাকায় যুবদলের একটি কর্মসূচি চলছিল। আন্দোলনকারীরা চাষাঢ়া অবস্থান নিলে ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির কিছু নেতাকর্মী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। সেখানে থাকা পুলিশের একটি জলকামান চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ শ্লোগান দেন।
একই সময়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শিমরাইল, কাঁচপুর, মোগরাপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে চাষাঢ়ায় থাকা এপিসি কারটি সরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান শিক্ষার্থীরা। পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হলে পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালান আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে চাষাঢ়া থেকে দুই নম্বর গেটের দিকেও রওয়ানা শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সড়কে মিছিলের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। বিপরীতে ছাত্রভঙ্গ হয়ে গিয়ে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মুহুর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শহর। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জেও।
অন্যদিকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে কলেজ রোডের মোড় থেকে একদল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মিছিল নিয়ে চাষাঢ়া চত্বরের দিকে আসে। এ সময় তাদের হাতে রাম দা, রড, হকিস্টিক, লাঠিসোটা ছিল। আগ্নেয়াস্ত্র থেকেও গুলি চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক মুনা বলেন, সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল ও অবরোধ কর্মসূচিতে ছিলেন তারা। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে চাষাঢ়ায় উত্তর চাষাঢ়া ও মিশনপাড়া এলাকা থেকে আসা লাঠিসোটা হাতে কিছু বহিরাগত যুবক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে পড়ে পুলিশের একটি গাড়িতে হামলা চালায়। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিছিল সহকারে এগিয়ে যাচ্ছিলাম পুলিশ তখন মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে।
ওই সময়ে নেতৃত্বে থাকা আরেক ছাত্রনেতা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের জেলা আহবায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আগেরদিন বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা খবর পেয়েছিলাম ১৮ জুলাই হামলা হবে। এ হামলায় অংশ নিবে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাই সকাল থেকে আমরা সকর্ত ছিলাম আর সব জায়াগা নজর রাখছিলাম। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে যারা মিনারে আসছিল তাদেরই প্রেসক্লাবের দিকে পাঠাচ্ছিলাম।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান জেলা কমিটির আহ্বায়ক নিবর রায়হান বলেন, ‘জ্বালাও-পোড়াও আমাদের লক্ষ্য ছিল না। ওইদিন সকাল ১১টায় সবাই একসাথে রাস্তায় নেমে আসে এবং চাষাঢ়া অবরোধ করে। এ সময় খানপুর থেকে পুলিশের একটি দল এসে আন্দোলনে বাধা দেয়। আমি ও আমাদের কিছু সহযোদ্ধারা চাষাঢ়ায় দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলতে যাই। তারা আমাদের গায়ে হাত দিয়ে বলছিল, ‘আমার তোমাদের পক্ষে।’ কথোপোকথনের মধ্যেই আমাদের এক সহযোদ্ধা বিল্লালের পায়ে ছররা গুলি করে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশ সদস্য। কোনোভাবে সেখানে থেকে বিল্লালকে নিয়ে আমরা জেনারেল হাসপাতালে যাই। পরবর্তীতে সংঘর্ষ বাড়লে আমাদের আরও সহযোদ্ধারা আহত হতে থাকলে এবং আমরা তাদের উদ্ধার করে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাই। প্রথম দিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা দিকে অস্বীকৃতি জানায়। বারবার বলার পর তারা রাজি হয়।’
ঘটনার দিন বিকেল পর্যন্ত শহরের দু’টি সরকারি হাসপাতালে অন্তত ৬০ জন আহত অবস্থায় চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলন জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল সুজনও গুলিবিদ্ধ হন। একই সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আহত হন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মোবাশ্বির শ্রাবণ ও নয়া দিগন্ত পত্রিকার ফটো সাংবাদিক ও দৈনিক ইয়াদ পত্রিকার সম্পাদক মনিরুল ইসলাম সবুজসহ আরও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী। মোবাশ্বির শ্রাবণের মাথায় তিনটি গুলি লাগে।
বিকেলে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার পুলিশ বক্স, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দেওভোগে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে।
এদিন শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে গভীর রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। রাতে সাইনবোর্ড এলাকায় নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। আগুন নেভাতে গেলে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়। রাতভরই থমথমে পরিস্থিতি ছিল নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে।