মনোনয়ন-বঞ্চিতদের পাশে পাচ্ছেন না ধানের শীষের প্রার্থীরা
নারায়ণগঞ্জ জেলায় সংসদীয় আসন পাঁচটি হলেও আসনগুলোতে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন দুই ডজনেরও বেশি নেতা। তাদের প্রত্যেকেই মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাপ কম করেননি। কিন্তু দল চূড়ান্তভাবে চারটি আসনে চারজনকে মনোনয়ন দিলেও এ প্রার্থীরা প্রচারণায় পাশে পাচ্ছেন না মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের। বরং অনেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রার্থীদের বিরোধীতাও করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দলের প্রার্থীর বাইরে গিয়ে নিজে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার কিংবা অন্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার পরিকল্পনায় আছেন বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠক বসে দলটির গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় সারাদেশে ২৩৭ আসনে দলটির প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটিতে এখনো কোনো প্রার্থী দেয়নি দল। তবে বাকি চার আসনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভূঁইয়া, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে নজরুল ইসলাম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে আজহারুল ইসলাম মান্নান এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মাসুদুজ্জামান মাসুদ মনোনয়ন পেয়েছেন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারাই হবেন দলটির সংসদ সদস্য প্রার্থী। ভোটের মাঠে ধানের শীষ প্রতীকে লড়বেন তারা।
বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিকবার বলেছেন, প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এবার তৃণমূলের কর্মীদের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতার গ্রহণযোগ্যতা, বিতর্কহীন ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। রাজধানীর পাশে গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে বিবেচিত নারায়ণগঞ্জের চারটি আসনে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করেছে দল। যাদের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে তাদের পক্ষেই বাকি সকল ইউনিট, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলীয় প্রার্থীর বাইরে গিয়ে কোনো বিতর্কিত কার্যক্রমে অংশ নিলে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে, এমন হুঁশিয়ারিও রয়েছে কেন্দ্র থেকে।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জে ধানের শীষের প্রার্থীদের চূড়ান্ত নাম ঘোষণার পর মনোনয়ন বঞ্চিত নেতারা অনেকেই নাখোশ। মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের মধ্যে কয়েকজনের কর্মকাণ্ড দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধেও যাচ্ছে। ধানের শীষের মনোনীত প্রার্থীদের স্বাগতও জানাননি তারা। গত তিনদিনে ধানের শীষের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় প্রচারণায় ব্যস্ত থাকলেও পাশে পাচ্ছেন না মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের। এমনকি তাদের সঙ্গে প্রার্থী দেখা করতে গেলেও দেখা দিচ্ছেন না। অনেক নেতা এখনো ব্যক্তিগতভাবে প্রচারে ব্যস্ত। নিজের আসনে ঘোষিত প্রার্থীর নাম উচ্চারণেও তাদের মধ্যে দ্বিধা-সংকোচ দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতার সংখ্যা ছিল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে। দলের মনোনয়ন পেতে কাজ করছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু, বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী আবু জাফর আহমেদ বাবুল, মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ ও শিক্ষক আলিয়ার হোসেন। আসনটিতে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে মাসুদুজ্জামানের নাম ঘোষণার আগে অন্য সব মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা এলাকায় এলাকায় বিএনপির ৩১ দফার লিফলেট বিতরণে ছিলেন ব্যস্ত। কেন্দ্রেও সেসব ছবি ও ভিডিও করে পাঠানো ছিল নিয়মিত কাজ। কিন্তু মাসুদুজ্জামান মনোনয়ন পাওয়ার পর গত তিনদিনে তাদের অনেককেই আর মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
তাদের মধ্যে সাখাওয়াত হোসেনকে আবার দলের ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল ক্যাম্পেইনেও অংশ নিতে দেখা গেছে। মাসুদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত দলের প্রার্থীর পক্ষে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেও দেখা যায়নি তাকে। একইভাবে আবু জাফর আহমেদ বাবুলও মনোনয়ন পাবার আগে যে তোড়জোড় দেখিয়েছেন তা আর চোখে পড়ছে না। মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ দলের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করলেও তিনি দল ঘোষিত প্রার্থীর পক্ষে কোনো কথা বলছেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয় খোরশেদ মাসুদুজ্জামান অভিনন্দন জানিয়েছেন এমন স্ট্যাটাসও চোখে পড়েনি। বাকি নেতাদেরও আচরণও দলীয় প্রার্থীর অনুকূলে মিলছে না।
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে মনোনয়ন পাওয়া আজহারুল ইসলাম মান্নানও পাচ্ছেন না মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের। তার আসনটিতে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ। হেভিওয়েট এই নেতাদের টপকে ধানের শীষের প্রার্থীর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন মান্নান। কিন্তু এ প্রার্থী এখন পড়েছেন বিড়ম্বনায়, পাশে পাচ্ছেন না দলের নেতাদেরই। এমনকি নিজ উদ্যোগে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও পাচ্ছেন না তাদের দেখা। বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জে দেখা করতে গিয়ে বিব্রত হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে।
নারায়ণগঞ্জ-১ এবং ২ আসনেও ধানের শীষের প্রার্থী যথাক্রমে মোস্তাফিজুর রহমান দিপু ভূঁইয়া এবং নজরুল ইসলাম আজাদও একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন। মনোনয়ন দৌড়ে দিপুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। দিপু এবং মনিরের দ্বৈরথ অনেক পুরোনো। এই দ্বন্দ্ব তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত মনিরকে পাশে পাচ্ছেন না দিপু ভূঁইয়া।
একইভাবে আজাদও পাচ্ছেন না সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর এবং বিএনপির সহঅর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমনকে। এ দু’জন মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা নিজেদের মতো করে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। দলীয় নির্দেশনা থাকলেও দলঘোষিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে তাদের দেখা যায়নি। এমনকি তাদের নেতা-কর্মীরাও ভিড়ছেন না দিপু ভূঁইয়ার পক্ষে কোনো প্রচারণায়।
শুধু তাই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নারায়ণগঞ্জের চারটি আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরা সকলেই আগামী ৭ নভেম্বর বিপ্লব সংহতি দিবসেও আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। একদিকে ধানের শীষের প্রার্থীরা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করতে চাচ্ছেন মনোনয়ন বঞ্চিতরা।
মনোনয়ন বঞ্চিত হেভিওয়েট নেতাদের এ ধরণের আচরণ দলকে দুর্বল করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির একাধিক নেতা। তারা বলছেন, দলের হাইকমাণ্ড দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বললেও অনেকেই এ নির্দেশনা মানছেন না। এতে ভোটের মাঠে দলের প্রার্থী দুর্বল হয়ে পড়বেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করবে। বিএনপি এই ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেও অনেকে তা মানছেন না। বিষয়টি কেন্দ্র খেয়াল করছে এবং বিদ্রোহী আচরণ করা নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া নির্দেশনাও আসবে।





































