কমিটিহীন ছাত্রদল, হতাশ তরুণ নেতৃত্ব

নারায়ণগঞ্জ ও জেলা মহানগরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে এক বছর আগে। দীর্ঘ সময়েও রাজধানীর পাশে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলে ছাত্রদলের কমিটি না থাকায় বিএনপির এ ছাত্র সংগঠনটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতাশায় ভুগছেন। তারা মনে করছেন, দ্রুত কমিটি না দিলে নেতা-কর্মীর মধ্যে হতাশা ও বিভাজন আরো প্রকট হবে। যা জাতীয়তাবাদী চেতনা বিশ্বাসী তরুণ নেতৃত্ব সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত করবে।
সংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের এক সিদ্ধান্তে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে জেলার আওতাধীন সব উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন, কলেজ ও ওয়ার্ড কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং অতি দ্রুত নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।
কিন্তু সময় গড়িয়েছে এক বছরের বেশি, তবুও ঘোষণা আসেনি কোনো নতুন নেতৃত্বের। ফলে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রদল কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় দিন পার করছে।
ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, বিগত সময়ে নারায়ণগঞ্জে ছাত্রদল ছিল সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠনগুলোর একটি। আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন- সব জায়গায় তাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তবে, নেতৃত্বের অভাবে সংগঠনের নেতাদের ছাত্রদলের কার্যক্রম এখন তেমন চোখে পড়ে না। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন পদপ্রত্যাশী নেতা তাদের অনুসারীদের নিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যরা বিএনপি নেতাদের পক্ষে তাদের হাত শক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম এগোচ্ছে না। তবে, কমিটির দীর্ঘসূত্রিতা তাদের মধ্যেও হতাশা তৈরি করেছে।
ছাত্রদলে নতুন কমিটিতে নেতৃত্বের জায়গায় আলোচিত কয়েকজন রয়েছেন যারা নতুন কমিটিতে আসতে পারেন। তাদের মধ্যে আছেন জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি সুলতান মাহমুদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের রহমান জিকু, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাহিদ ইসতিয়াক সিকদার, সাকিব মোহাম্মদ রাইয়্যান, সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম রাজীব, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নিরব, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান দোলন, সিদ্ধিরগঞ্জ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের জিলানী, ফতুল্লা ছাত্রদল নেতা শাকিল আহমেদসহ বেশ কয়েকজন নেতা। এছাড়া, গত কয়েকমাসে ঘোষিত বিভিন্ন কলেজ শাখা কমিটির নেতারাও জেলা ও মহানগর কমিটিতে যুক্ত হবার যোগ্য দাবিদার বলে মনে করছেন অনেকে।
সংগঠনটির নেতারা বলছেন, নেতৃত্ব না থাকলে কর্মী মাঠে নামবে কীভাবে? সবাই দিক-নির্দেশনার অপেক্ষায়। তবে, এই স্থবিরতা ছাত্রদলের সংগাঠনিক শক্তিকেও দুর্বল করে তুলেছে বলে মনে করেন তারা।
তাদের মতে, একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন যদি টানা এক বছর নেতৃত্বহীন থাকে, তবে মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্টতর হওয়া স্বাভাবিক।
দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের নতুন কমিটি অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংসদ। সেই কমিটিতে সভাপতি ছিলেন নাহিদ হাসান ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের রহমান জিকু। নয় সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটিতে আরও ছিলেন, সিনিয়র সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ, সহ-সভাপতি সাগর সিদ্দিকী, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া ভূঁইয়া, যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও আবু তাহের রিফাত, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান দোলন প্রমুখ।
একই দিন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাকিবুর রহমান সাগরকে সভাপতি এবং রাহিদ ইসতিয়াক সিকদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছিল। এই দুই কমিটিই প্রায় এক বছর সক্রিয় থাকার পর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে, এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
ছাত্রদলের একাধিক নেতার অভিযোগ, বিলুপ্তির পেছনে ছিল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তারের লড়াই। কেন্দ্রীয় নির্দেশনার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের অসামঞ্জস্য, নেতৃত্বে অস্থিরতা এবং কিছু সাংগঠনিক অসন্তোষই নাকি এই সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছিল।
গত বছরের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে নতুন করে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু দলটির অভ্যন্তরে বিভক্তি ও প্রভাব বিস্তারের লড়াই বেড়ে যায়। এই সময় অনেক স্থানীয় নেতা নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, যা ছাত্র সংগঠনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, দলের নেতৃত্বে এখন এক ধরনের হাহাকার চলছে। কেউ কাউকে মানে না, সবাই নিজেকে প্রভাবশালী দেখাতে চায়। এই পরিবেশে ছাত্রদল নতুন করে সংগঠিত হতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ছাত্রদল যদি দ্রুত নতুন কমিটি ঘোষণা না করে, তবে নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় সংগঠন পুনর্গঠন কঠিন হয়ে পড়বে। নেতৃত্বের শূন্যতা শুধু কর্মসূচি বাস্তবায়নেই নয়, নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের আগ্রহেও প্রভাব ফেলছে।
সংগঠনের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নতুন কমিটি গঠনের চিন্তা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণ ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিবর্তনের কারণে বিষয়টি স্থগিত হয়ে যায়। তবে শীঘ্রই নতুন কমিটি আসবে বলে আশা করছেন নেতারা।
মহানগর ছাত্রদল নেতা আজিজুল ইসলাম রাজীব বলেন, “আমাদের কমিটি ভাঙার পর বলা হয়েছিল- খুব দ্রুত নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। তবে এখনো গঠন করা হচ্ছে না। ৫ তারিখের পরে সবার আশা আকাঙ্খা ছিল ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান হওয়ার পর আমরা ছাত্রদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো।”
“ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা হিসেবে আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিলো ব্যাপক। তারা সে ধারাবাহিকতায় নতুন বাস্তবতায় তরুণরা প্লাটফর্মে আসতে চায়। কিন্তু আমরা সে বাস্তব রূপ আমরা দিতে পারছি না, কমিটি না থাকার কারণে। এতে তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এমনকি আগ্রহ থাকার পরেও কমিটি না থাকায় অনেকে নানা সংগঠনে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। সামনে নির্বাচন এতে জাতীয়তাবাদী দলের জন্য ছাত্রদলের ভূমিকার অনেক গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু কমিটি যদি দেরি করা হয় তাহলে থানা, ওয়ার্ডে নেতা-কর্মীদের কার্যক্রম গুছিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে।”
তবে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হতে পারে বলে আভাস পেয়েছেন বলে জানান আশরাফুল ইসলাম নিরব। তিনি বলেন, “সামনে নির্বাচন কিন্তু এখন ছাত্রদলের কমিটি নাই। নির্বাচনে কিন্তু ছাত্রদলের ভূমিকা লাগবে জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে। দেশ নায়ক তারেক রহমান শুরু থেকেই বলছেন, এই নির্বাচন খুবই কঠিন হবে। সেখানে আমি মনে করি, ছাত্রদলের কমিটি দিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা একত্রে কাজ করতে পারবো। কেন্দ্র থেকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কলেজের কমিটি দিয়েছে। তারা গুছিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে আবার তারা ক্লিন ইমেজের ছাত্রদের সদস্য হিসেবে নিচ্ছে যা একটা বিশেষ দিক। তবে কলেজে নেতৃত্ব দেওয়া কমিটির মধ্যে অনেকেই আছে যারা জেলা ও মহানগরে আসার যোগ্য। কমিটি হলে ছাত্রদল যোগ্যদের পাবে।”