২৪ অক্টোবর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:৪২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ‘ফ্যাক্টর’ স্বতন্ত্র প্রার্থী মাকসুদ

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ‘ফ্যাক্টর’ স্বতন্ত্র প্রার্থী মাকসুদ

সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এখনো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়নি, তার আগেই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা শহর ও বন্দর চষে বেড়াচ্ছেন। তবে, তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম মাকসুদ হোসেন। সাবেক এ জাতীয় পার্টির নেতা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বন্দর উপজেলার সাবেক এ চেয়ারম্যান আসনটিতে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন বলে মনে করছেন অনেকে। কেননা, গত উপজেলা নির্বাচনে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকে হারিয়ে বেশ আলোচিত মাকসুদ হোসেনের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে বন্দরে।

প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত আসনটি নারায়ণগঞ্জ-৫। এ আসনটিতে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে মরিয়া বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে প্রচারে ব্যাপক সময় পার করছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, সাবেক যুবদল নেতা ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদ, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ বাবুল, নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, লন্ডনের নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আলিয়ার হোসেন।

এদিকে, জামায়তে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মইনুদ্দিন আহমাদ, ইসলামী আন্দোলন মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ্, খেলাফত মজলিস মনোনীত সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী এবিএম সিরাজুল মামুন নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এছাড়া, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সংগঠক শওকত আলী ও কেন্দ্রীয় সদস্য আহমেদুর রহমান তনুও নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গোছাচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে প্রচার-প্রচারণায় তাদের ব্যাপকতা দেখা না গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব উপস্থিতি রয়েছে তাদের।

তাদের সকলেই নির্দিষ্ট দল থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা ভাবছেন মাকসুদ হোসেন। তিনি বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। এর আগে মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদে তিনবার চেয়্যারম্যান নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সাবেক এ সহসভাপতি গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হন। মূলত সেবার প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের নিষেধ সত্ত্বেও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পদ হারান তিনি।

তার বিপরীতে তখন আওয়ামী লীগের বন্দর উপজেলা কমিটির সভাপতি এম এ রশীদ এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান মুকুল প্রার্থী হয়েছিলেন। ওসমান পরিবার সমর্থন দিয়েছিল এম এ রশীদকে। ওসমানদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রার্থী হওয়ায় সেলিম ওসমান ওই সময় প্রকাশ্যে মাকসুদকে নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। ওসমানদের প্রবল বিরোধীতার মুখেও বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তাক লাগিয়ে দেন মাকসুদ। 
গত বছরের ৮ মে বন্দর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আনারস প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন মাকসুদ হোসেন। ওই নির্বাচনে তিনি পান ২৯ হাজার ৮৭৪ ভোট, যেখানে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আতাউর রহমান মুকুল পান ১৫ হাজার ৬৫৩ ভোট এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এমএ রশিদ পান ১২ হাজার ৬০৮ ভোট। এই জয় তাকে জেলার অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিণত করে। এবার নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে এ আসনের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দাঁড় করিয়েছেন।

স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক ও পেশাজীবী নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটি সদর ও বন্দর থানা এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত। ভোটার সংখ্যা সদরে বেশি হলেও বন্দর উপজেলাতেও এ সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আর এই ভোটারদের উপর মাকসুদের বড় প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব আরও বেড়েছে গত উপজেলা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পাবার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া, মুছাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মাকসুদ তার নিজের এলাকাতেও বড় একটি ভোটব্যাংকের দাবিদার। কেননা, এই ইউনিয়ন থেকে তিনি তিন-তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এলাকার মানুষজন তাকে দানশীল ও দুঃসময়ের কান্ডারি বলেই চেনেন। ফলে বন্দর অংশের কারণেই এ আসনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবেন মাকসুদ।

মাকসুদের কর্মী-সমর্থকরা বলছেন, মাকসুদ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে এলাকার উন্নয়নমূলক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগত অর্থায়ণে বন্দরের নবীগঞ্জ স্ট্যান্ড থেকে মিনারবাড়ি সড়ক, ধামগড় ইউনিয়নের ইস্পাহানী বাজার থেকে চাঁন মার্কেট সড়ক এবং মিনারবাড়ি থেকে লাঙ্গলবন্দ সড়কসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের গর্ত ও খানাখন্দ সংস্কার করে স্থানীয় জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের ছোট-বড় রাস্তা, ব্রিজ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, অসহায় পরিবারকে ঘর তৈরি করে দেওয়া, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, ঈদগাহ ও মন্দিরে আর্থিক সহায়তা এবং অসুস্থদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের মতো জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে তার ভূমিকা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বন্দর উপজেলার ১৬টি দুর্গাপূজা মন্ডপে উপস্থিত হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করে প্রতিটি পূজামন্ডপে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন তিনি। এ ছাড়াও বিভিন্ন পূজা মন্ডপে নারীদের শাড়ি বিতরণ করেন তার স্ত্রী নার্গিস মাকসুদ।

তবে, মাকসুদ হোসেনের বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াতে পারে তার এক সময়ের ওসমান পরিবারের সঙ্গে সখ্যতার বিষয়টি। তিনি এক সময় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ছিলেন। বন্দর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে সবসময় ‘মাই ম্যান’ বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মাকসুদও। গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ওসমান পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হলেও পুরোনো সখ্যতার মাশুল গুনতে হয় তাকে গণঅভ্যুত্থানের পর। জুলাই আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ওসমান পরিবার ও তার দোসরদের সঙ্গে আসামি হন মাকসুদও।

গত মার্চে ওই মামলায় যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযানে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারও হন মাকসুদ। যদিও পরবর্তীতে তিনি জামিনে মুক্ত থেকে আবারও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন এবং আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাকসুদ হোসেনের দীর্ঘদিনের জনসম্পৃক্ততা, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং মাঠে সক্রিয় উপস্থিতি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বন্দরে একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। শহরেও প্রচারণা শুরু করেছেন তিনি। তার পক্ষে তার স্ত্রী দুর্গা পূজায় ও শ্যামা পূজায় টানবাজার, দেওভোগ ও খানপুরে প্রচারণা করেছেন।

মাঠপর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ মাকসুদ হোসেনের শক্তির জায়গা বলে মনে করেন তার সমর্থকরা। তারা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে তার সুনাম, মানবিক কর্মকাণ্ড ও জনপ্রিয়তা ইতোমধ্যেই ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তার রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মী। অনেকেই মনে করছেন, তিনি যদি সঠিক কৌশলে প্রচারণা চালাতে পারেন এবং তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের সুসংগঠিত করতে পারেন, তাহলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বড় দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য তিনি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়