ত্বকীর ৩০ বছর

ত্বকীর জন্মের দিনটি ছিল বিজয়া দশমী। চারদিকে ঢাকের বাদ্যে ৫ অক্টোবর বিকেলে ত্বকীর জন্ম। কবি সুকান্ত বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আমিও ত্বকী ভূমিষ্ঠ হবার দিন সুকান্তর মতো অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু না, আমি আমাদের এ জনপদকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারিনি। সুকান্তের মৃত্যু হয়েছিল একুশ বছরে যক্ষ্মা রোগে আর ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে। ত্বকীর আগে পরে কত শিশু-কিশোরকে হত্যা করা হলো। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে হত্যা করা হল ১৩৩ জন শিশু। রাজনীতির পরাকাষ্ঠায় প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে আমাদের নিষ্পাপ-নিরপরাধ সন্তান। বিশ্ব শিশুর বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। গাজায় গত ২২ মাসে হত্যা করা হয়েছে উনিশ হাজার শিশু। হত্যা এখনো থামেনি। কে থামাবে এই হত্যা যজ্ঞ! কোথায় গিয়ে থামবে এই বর্বরতা?
আমাদের পাঠ্য বইয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘তারুণ্য’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘তরুণেরা প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা, উল্লাসের প্রতীক, ঔদার্যের মহিমায় ভাস্বর।’ আমাদের সন্তানরা তারুণ্যের স্বপ্ন বুকে জীবন জয়ের পথে ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানে প্রতিনিয়তইতো এগিয়ে যাচ্ছে। অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্র মেরামত করতে যেয়ে দুই হাজার তরুণ-শিশু জীবন দিল। প্রশ্ন জাগে ধন ধান্য পুষ্প ভরা এই দেশটির পরিচয় ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হয়ে থাকবে কেন? এত এত রক্ত বৃথা যাবে কেন?
আজ ত্বকীর জন্মদিন। ৩০ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু না ত্বকীর বয়স আর বাড়বে না। তা আটকে আছে ১৭ বছর ৫ মাসের বৃত্তে। এ হত্যার বিচারটিও হয়নি। বিগত সরকার সাড়ে এগারো বছর বিচার থামিয়ে রেখেছিল, এ সরকার তা শুরু করলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
ত্বকী বেঁচে থাকতে একটা ছড়া প্রায়ই আবৃত্তি করতাম, ‘মন্দরা ছিল মন্দরা আছে থাকবেও চিরকাল, তবুও ভালোর ছোঁয়া লেগে শুভ হোক আগামীকাল।’ এখন আমার কণ্ঠ থেকে কোনো ছড়া, কবিতা বা গান বের হয় না। কিন্তু আমার চোখের জলে কোনো স্মৃতি মুছে যায়নি, ত্বকীর সাথের প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি মুহূর্ত থেকে আমি ফিরে পেতে চাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ত্বকীর সাথে আমার জীবনযাপনের আকাক্সক্ষায়, অথচ যা আর কোনোদিন হবার নয়। কিন্তু ত্বকী যে ভালোর ছোঁয়ায় পৃথিবীকে মঙ্গলে, শুভ্রতায় ছেয়ে দিতে চেয়েছিল সেই ভালোর পথ আজ যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে।
ত্বকীকে আমি ভালোবাসতে শিখিয়েছিলাম এ জন্মভূমিকে। ও ভালোবাসতে শিখছিল। এ দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে আশায় বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। বিদেশ যেতে চায়নি। আমরা পড়াশুনার জন্য দেশের বাইরে যেতে বললে যেতে চায়নি। দেশে থেকে দেশের জন্য ভাবতে, করতে, বড় হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। ত্বকী কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের পথে পা বাড়িয়ে ছিল। ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে বৃহতের উদ্দেশ্যে সবে যাত্রা শুরু করেছিল। আমাদের চাওয়াতো আমাদের সন্তানেরা প্রাণপ্রাচুর্যে, উল্লাশে, ঔদার্যে, নির্ভয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। দেশকে, বিশ্বকে নিজের করে নেবে। ত্বকী তার ক্ষুদ্র সময়ে সমাজের বৈষম্যের জঞ্জালকে প্রাণপণে সরাবার অঙ্গীকার করেছিল। ত্বকী একটি কবিতায় লিখেছিল, ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে,/ হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ একটি সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল ত্বকী। কিন্তু কতটা বিরুদ্ধ সমাজে বসে সে এ স্বপ্ন দেখছে এ ধারণা হয়তো তার ছিল না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, ‘বালক জানে না কতটা হেঁটে এলে ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।’ এই কারণেই আমার ত্বকীর আর পথ হাঁটা হলো না।
আমি যখনই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানুষ’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করতাম ‘মানুষ বড় কাঁদছে তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’- তখন প্রতিবারই আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শিশুসন্তান আপন মনেই বলে চলত ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমাকে দাঁড়াতেই হবে’। দাঁড়াবার মূল্য আমি পেয়েছি। আমাদের এইসব সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার জীবন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রক্ষার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের, সমাজের। কিন্তু সমাজে যখন বিবেকহীনদের আধিপত্য চলে তখন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বাঁচবে কী করে! আমাদের এই দেশটাতে ত্বকী, সাগর-রুনি, অভিজিৎ, ওয়াসিকুর, দীপন, তনু, আবরার, মিতুদের সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকল। গত বছর ছাদে খেলতে খেলতে জীবন দিল রিয়া গোপ।
আমরা রাজনীতির জিঘাংসার পথ থেকে পরিত্রাণ চাই। অবিচার কখনো শেষ কথা হতে পারে না। আমরা ন্যায় বিচার চাই। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচারের জন্য একাত্তর এসেছে, চব্বিশ এসেছে। এত এত আত্মদান। সেই স্বপ্ন কী এখনো সুদূর? কত দূর? এর উত্তরতো আমাদেরকে দিতে হবে। কারণ ত্বকীদের বাঁচতে দেয়া না হলেও এই দেশতো ত্বকীদের দেশ। এর গাছ-পালা, নদী-নালা, খাল-বিল এই শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র নদীতে, মাটিতে মিশে আছে ত্বকী। বেঁচে থাকা ত্বকীদের জন্য আমাদের এই দেশ বাঁচবে, বেঁচে থাকবে। একে যে বাঁচাতেই হবে।