নারায়ণগঞ্জে বছরে কমছে কৃষিজমি, দূষণে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য ও কৃষি

নারায়ণগঞ্জের শিল্প দূষণের বাস্তব চিত্র অনুধাবন, প্রতিরোধের উপায় এবং সমাধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নির্ধারণের লক্ষ্যে “পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষায় শিল্প দূষণ রোধ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (২৭ আগস্ট) সকালে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর উদ্যোগে এই সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন। বেলার প্রোগ্রাম অ্যান্ড ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর এ এম এম মামুনের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন পরিবেশ অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ, বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মাদ ইসমাইল হুসাইন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সহকারী প্রধান আহমাদ শামস কাদির, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ আহমেদ, এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. জহিরুল হক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. উমর ফারুক, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক সোহেল আখতারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “শিল্প দূষণ রোধে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ছাদ বাগানসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। মানুষ সরাসরি ড্রেনে বর্জ্য ফেলছে, যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ। এখন থেকেই সচেতনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
বেলার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এ এম এম মামুন বলেন, ধারণক্ষমতার বাইরে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী এখন দেশের তৃতীয় দূষিত নদী। নতুন কোনো শিল্পকারখানার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি জানান, প্রতি বছর নারায়ণগঞ্জে এক শতাংশ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণের কারণে কৃষকরা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন।
পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ বলেন, “৪২টি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকিরা ইটিপি স্থাপন করেছে। তবে অনেক কারখানা লাইসেন্স ছাড়াই চালু রয়েছে। শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন জরুরি।”
বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মাদ ইসমাইল হুসাইন বলেন, “শহরের ভেতর ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান খালে বর্জ্য ফেলছে, যা পরে নদীতে গিয়ে মিশছে। জনগণের সোচ্চার থাকার কারণেই নদীগুলো এখনো টিকে আছে।”
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সহকারী প্রধান আহমাদ শামস কাদির বলেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মানসিকতার পরিবর্তন ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া দূষণ রোধ সম্ভব নয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ আহমেদ জানান, শিল্প দূষণের পাশাপাশি অনুমোদনহীন সাঁকো ও বর্জ্য খালের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ইতিমধ্যে ৯টি খাল পুনঃখনন করা হয়েছে এবং সিটিপি স্থাপনের উদ্যোগ চলছে।
এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী ইয়াসির আরাফাত বলেন, “ওয়েস্ট উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। প্লাস্টিক ওয়েস্ট রিসাইকেল করে রাস্তা কারপেটিং প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. জহিরুল হক বলেন, “নারায়ণগঞ্জের সবজিতে সহনীয় মাত্রার বেশি ক্যাডমিয়াম পাওয়া যাচ্ছে। এতে কৃষিজমির উৎপাদনক্ষমতা কমছে এবং ভারী ধাতু খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।”
নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের পরিচালক সোহেল আখতার বলেন, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় প্রতিনিধি ও তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইটিপি ছাড়া কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় না।”
এ ছাড়াও সভায় উপস্থিত সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা শিল্প ও নগরায়ণের কারণে পরিবেশ, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং নদ-নদীর ওপর ভয়াবহ প্রভাব তুলে ধরে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহকারী সচিব সৈয়দ আহমেদ আলি এবং শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ ওয়ালিউল্লাহ।