মৌলিক সংস্কার না হলে স্বৈরাচারী কাঠামো বিরাজমান থাকবে: বদিউল

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, “মৌলিক সংস্কারগুলো না হলে স্বৈরাচারী কাঠামো বিরাজমান থাকবে। এবং আবারও স্বৈরাচারের প্রত্যাবর্তনের সম্ভবনা থেকে যাবে।”
শনিবার (৫ জুলাই) সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি রেস্তোরাঁয় সুজন আয়োজিত ‘জাতীয় সনদ ও নাগরিক প্রত্যাশা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম আরও বলেন, “নির্বাচনই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ আমাদের স্বৈরাচার বিতাড়িত হয়েছে কিন্তু স্বৈরাচারী ব্যবস্থা এখনও বহাল আছে। যে সাংবিধানিক কাঠামো, আইন-কানুন, প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত করেছে সেগুলো এখনও বিরাজমান। এগুলোতে পরিবর্তন না আনা হলে আবারও স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি হতে হবে।”
“আমি কিন্তু বলছি না, নির্বাচনের প্রয়োজন নাই। নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে এবং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হবে। এবং দ্রুততর সময়ের মধ্যে হতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের পাশাপাশি কতগুলো সংস্কার ও পরিবর্তনও দরকার”, যোগ করেন তিনি।
সংলাপের শুরুর দিকে বক্তব্যে তিনি কয়েকটি মৌলিক সংস্কারের কথা তুলে ধরেন। এগুলো ‘অবশ্যই বাস্তবায়ন’ হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কথায় কথায় নিজের এবং দলীয় স্বার্থে যাতে সংবিধান সংস্কার বা পরিবর্তন করা না যায় সেই সংস্কারও করতে হবে। এটিও একটি মৌলিক সংস্কার।”
সংসদে নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়া ও সংরক্ষিত আসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এখানে যোগ্যতা হবে মূল মাপকাঠি। যারা নারী ও রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করতে পারবে তাদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করতে পারবেন ভোটাররা। এক্ষেত্রে যারা নির্বাচিত হবেন তাদের ক্ষমতা সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিতদের মতো থাকবে। কোনো রকম বৈষম্য হবে না। এখন তো নারীদের আসন নামকাওয়াস্তে আছে। এমনকি নারীরা সাধারণ আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবেন। এক সময়ে দেখা যাবে নারীদের জন্য আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজনও হবে না।”
চলতি মাসেই ‘জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষরিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার হচ্ছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধীতা আছে। আমরা আশা করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবো। ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হবে। আশা করছি, এ মাসের মধ্যেই হবে। এই জুলাই মাসেই অনেকে প্রাণ দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য, স্বীকৃতি হিসেবে এ মাসেই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করি।”
“অনেকগুলো বিষয়ে সংস্কার হচ্ছে এবং হবে, কিন্তু কতগুলো মৌলিক সংস্কার হওয়া দরকার। কতগুলো মৌলিক সংস্কার যদি না হয় তাহলে কিন্তু আবারও পণ্ডশ্রম হবে। কতগুলো মৌলিক সংস্কারের মধ্যে একটা সংস্কার হলো- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টানা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান বলেছিলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীদের ক্ষমতা সেই মোঘল সম্রাট ও রাজাদের থেকেও বেশি ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেই কিন্তু স্বৈরাচাররা আমাদের ঘাড়ে উঠে বসেছে এবং সরকার ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম টানা দরকার”, যোগ করেন সুজন সম্পাদক।
তিনি বলেন, “এখন যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই সংসদের নেতা, একইসাথে দলীয় প্রধান। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেতা একসঙ্গে হওয়াটা।”
“আওয়ামী লীগও কিন্তু ‘দিন বদলের সনদ’র কথা বলে ইশতেহার দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়ি হওয়ার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু সরকার গঠনের পর সেই ইশতেহার বাস্তবায়ন হয়নি এবং দল থেকেও সেটি কার্যকর করতে যে চাপ প্রয়োগ করার কথা ছিল সেটিও করেনি। কেননা যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই আবার দলীয় প্রধান। ফলে সরকারি বাহিনী যেভাবে অন্যায় করেছে তাতে যোগ দিয়েছে দলের লোকজনও। তাই এই ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, নয়তো সেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় আমরা আবারও ফিরে যেতে পারি।”
বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, “রাষ্ট্রের কমিশনগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন হওয়া দরকার। যাদের মেরুদণ্ড শক্ত তাদের নিয়োগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনগুলোতে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।”
রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে নাগরিকের সচেতন ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল হক। আরও বক্তব্য রাখেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি, আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি মো. নূরউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন পন্টি, নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুস সালাম, সুজনের মুন্সিগঞ্জ জেলার সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, নরসিংদীর সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস প্রমুখ।
এ সংলাপে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার নাগরিক প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। তারা আলোচনায় সুজন প্রস্তাবিত ‘জাতীয় সনদ’ নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন।