বিএনপির ‘বস্ত্রহরণের’ রাজনীতি

গত কয়েকমাসের ব্যবধানে মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন স্থানীয় দুই বিএনপি নেতা। দু’জনই দলীয় লোকজনের হামলার শিকার হন। মারধরের সময় উভয়কেই প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। দু’টি ঘটনারই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে রোববার (২৯ জুন) দুপুরে বন্দর উপজেলার হরিপুর এলাকায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে হামলার শিকার হন এ উপজেলার দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল। তাকে হামলার পেছনে স্থানীয় এক বিএনপি নেতার ‘ইন্ধন’ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হামলাকারীরা কেবল তাকে মারধরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার পরনের কাপড়ও ছিঁড়ে প্রায় বিবস্ত্র পড়ে ফেলা হয় তাকে। তা আবার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর আগে একইভাবে হামলার শিকার হন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু। তাকে বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকায় ব্যাপক মারধর করা হয়। ওই সময়ও টিপুর পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেন হামলাকারীরা। ঘটনার দিন, গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন এ বিএনপি নেতা।
তার উপরও হামলার অভিযোগ ওঠে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতার বিরুদ্ধে। ওই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও হয়।
এ দু’টি ঘটনার পর্যবেক্ষণে অনেকে বিএনপি নেতাদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘বিএনপির বস্ত্রহরণের রাজনীতি’ হিসেবেও দেখছেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাব বজায় রাখতে এখন বিএনপির দলীয় নেতা-কর্মীদের এমন মুখোমুখি অবস্থান, সংঘর্ষ, হামলা, মারামারি দলের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন আসে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই এখন পলাতক থাকায় সেই জায়গায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে মরিয়া বিএনপির নেতারা।
ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাট, মাঠ, ঘাটের দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে টেন্ডারের দখলে নাম আসছে বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের। এমনকি গত কয়েকমাসে স্থানীয় আধিপত্য ধরে রাখার দ্বন্দ্বে দলটির দুইপক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। কয়েকদিন আগে বন্দর উপজেলাতেই এ কারণে দ্বন্দ্বে স্থানীয় বিএনপি সমর্থকদের দু’টি পক্ষের দ্বন্দ্বে খুন হন একজন দিনমজুর এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা।
গত কয়েকমাসের বিএনপির কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুলের উপর হামলা ও তাকে ‘বিবস্ত্র’ করার বিষয়টি।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বন্দরের হরিপুর ৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ঠিকাদারি কাজ পায় এমএস দেওয়ান এন্টারপ্রাইজ। এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল।
রোববার তিনি এ ঠিকাদারি কাজের বিষয়ে কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সামনে যান মুকুল। সেখানে তার গাড়ি থামার পরপরই একদল ব্যক্তি হামলা চালান। পরে গাড়ি থেকে তাকে টেনে-হিচড়ে বের করে মাটিতে ফেলে ব্যাপক মারধর করা হয়। পরনের পাঞ্জাবি ও পায়জামাও ছিঁড়ে ফেলে তাকে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। তাকে মারধরের সময় ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে গালাগালিও করা হয়।
পুরো ঘটনাটি যখন ঘটে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। পরে পুলিশই ৬৮ বছর বয়সী সাবেক এ বিএনপি নেতাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
মুুকলের অভিযোগ, চাঁদা দাবি করেও না পেয়ে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি বজলুর রহমানের নির্দেশে তার অনুসারীরা এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বজলুর রহমান।
বন্দর উপজেলার দুইবারের চেয়ারম্যান মুকুল নিজেও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যদিও মহানগর বিএনপির সাবেক এ সহসভাপতি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কৃত হন।
বন্দর থানার ওসি লিয়াকত বলেন, কয়েকদিন আগে হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি কাজের দরপত্র উন্মুক্ত হয়। কাজটি পায় এমএস দেওয়ান এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুপুরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে যান আতাউর রহমান মুকুল। তখন তাকে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মারধর ও হেনস্থা করেন।
“যারা হামলা করেছে তারা স্থানীয় বিএনপি নেতা বজলুর রহমানের অনুসারী। ঠিকাদারি কাজটি পেতে তারাও দরপত্র দিয়েছিলেন”, যোগ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর বিকেলে মুকুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমি নিজে ঠিকাদারি কাজ করি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই কাজটি আমি করার দায়িত্ব পেয়েছি। আমি এইটার জন্য সরকারি কাগজপত্রে স্বাক্ষরের জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেখানে যাবার পরপরই আমার উপর হামলা হয়। আমাকে গাড়ি থেকে টেনে-হিচড়ে নামিয়ে মারধর করে জামা-কাপড় সব ছিড়ে ফেলে।”
“বজলুর রহমানের সঙ্গে আমার কখনই খারাপ সম্পর্ক ছিল না। আমরা একসাথে জেলও খাটছি। কিন্তু ও আমার উপর এইভাবে হামলা করাবে এই ধারণাও করতে পারি নাই।”
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বজলুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছিল হরিপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ‘ওভারহোলিং’ এর কাজ পাওয়া এমএস দেওয়ান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে আব্দুস সোবহান নামে এক ব্যক্তি এ অভিযোগ দেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, চাঁদা না দিলে কোনো কাজ করতে পারবে না বলেও গত ২৩ জুন বিএনপি নেতা বজলুর রহমান ও তার অনুসারীরা হুমকি দেয়।
হামলা হতে পারে শঙ্কা থেকে পুলিশকে অবগত করেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বলে জানান আতাউর রহমান মুকুল। ঘটনার সময় সেখানে চারজন পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন।
মুকুল বলেন, “পুলিশও কাউকে থামাতে পারেনি।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আল মেহেদী বলেন, “ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগ ও নিরাপত্তাজনিত শঙ্কার কারণে ঘটনাস্থলে স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশ পাঠানো হয়। কিন্তু পুলিশ পৌঁছানোর দু-এক মিনিটের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে যায়। তাৎক্ষনিক পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা হেফাজতে নেন।”
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু তার দলীয় কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন।
এই হামলার পেছনে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবুল কাউসার আশার ‘ইন্ধন’ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন টিপু। তিনি পরে থানায় আশাসহ আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে মামলাও করেন।
যদিও তখন আশা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের ‘মামলায় ফাঁসিয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করায়’ দলের একদল ক্ষুব্দ কর্মী তাকে মারধর করেছে।
ঘটনার পর আহত আবু আল ইউসুফ খান টিপুকে শহরের খানপুর এলাকার নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, বিকালে বন্দর একটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে কর্মীদের নিয়ে উপজেলার তিনগাঁও এলাকায় যাচ্ছিলেন টিপু। পথে তিনি হামলার শিকার হন। তাকে মারধর করার একটি ভিডিওতেও তাকে রাস্তায় ফেলে পেটাতে দেখা গেছে। এ সময় তাকেও প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভেতরেই বারবার ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও প্রকাশ্যে লাঞ্ছনার ঘটনাগুলো বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্বে গভীর বিভাজনের ইঙ্গিত দেয়। ক্ষমতাসীন দলের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে দলটির অভ্যন্তরে টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা এখন প্রকাশ্য সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু বিএনপির ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টাকেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।