১৮ জুলাই ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯:১৯, ১৭ জুলাই ২০২৫

মুনার স্মৃতিচারণ  

রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক ‘ঐতিহাসিক দিন’ ১৭ জুলাই

রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক ‘ঐতিহাসিক দিন’ ১৭ জুলাই

গত বছরের ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ, রেলপথ অবরোধ ও মাতম মিছিলের দিনটিকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক ‘ঐতিহাসিক দিন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ও আন্দোলনের সংগঠক ফারহানা মানিক মুনা। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্মৃতিচারণমূলক দীর্ঘ পোস্টে তিনি এদিনের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

পোস্টে মুনা লেখেন, “১৬ জুলাই রাত ছিল আমাদের জন্য দুশ্চিন্তায় ভরা রাত। একদিকে ছাত্রলীগের হামলার প্রস্তুতির খবর, অন্যদিকে আন্দোলনের জমায়েত নিয়ে নানা ভাবনা। তবে আমরা ছিলাম স্পষ্ট—Whatever happens, the show must go on।”

পরদিন ১৭ জুলাই, আশুরার দিন। আন্দোলনকারীরা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনো পরিস্থিতিতেই মাঠ ছাড়বেন না। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রেসক্লাবের সামনে না পারলে আশুরার তাজিয়া মিছিলে গেরিলা কায়দায় জমায়েত হওয়ার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়।

সকাল ৯টায় প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত হন আন্দোলনকারীরা। মুনা জানান, “আগের রাতের সকল দুশ্চিন্তা বদলে যায়। কত কলেজ, কত স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখা পাই, তার হিসেব নেই। আইডিয়াল, প্রিপারেটরি, নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল, আদর্শ স্কুলের ছাত্ররা আমাদের কিশোর শক্তি হয়ে উঠেছিল। আমরা তখন হাজারে হাজার।”

মিছিল শুরু হয় —“আমার ভাই মরলো কেন, খুনি হাসিনা জবাব চাই।” স্লোগানে। শহরজুড়ে সেই স্লোগানের গমগম শব্দে তৈরি হয় উত্তাল পরিবেশ। ডিআইটি পৌঁছাতেই রাসেল পার্ক থেকে আরেকটি মিছিল এসে যুক্ত হয়, যেখানে ছিলেন সাফা, জুনায়েদ ও কারাবন্দি শিক্ষার্থী জিসানের বন্ধুরা। আন্দোলনের মুখ জিসান গত ৬৫ দিন ধরে বিনা বিচারে কারাভোগ করছে বলেও মুনা তার পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। 

সেই মিছিলের পর সেদিন প্রথমবারের মতো নারায়ণগঞ্জে রেলপথ অবরোধের ঘোষণা আসে। দুই নম্বর গেটের রেললাইনে বসে পড়েন নারী শিক্ষার্থীরা। আশপাশের দোকানিদের থেকে পানিসহ নানা সহায়তা পান তারা, এমনকি ইন্টারনেট সংযোগও পান।

একজন বাবা তাঁর মেয়েকে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তায় সঁপে দিয়ে পাশে থাকার বার্তা দেন। মুনা বলেন, “তিনি বললেন, ‘নিরাপত্তা পাই না, তাই সাথে আসছি।’ আমি তাঁকে সালাম করে বলি, ‘আপনারা আছেন তা জানি, জানি বলেই সাহস পাই।’”

হামলার আশঙ্কায় ছাত্রদলের সঙ্গেও সমন্বয় করা হয়। ছাত্রদল নেতা আলিমুল সিফাত ১৪ জুলাই থেকেই মিছিলে যুক্ত ছিলেন। রেল অবরোধ শেষে মিছিল যায় চাষাঢ়া চত্বরে, যেখানে আয়োজিত হয় গায়েবানা জানাজা।

মুনা জানান, জানাজা ঘিরে ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা হয়। যদিও তারা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে জানাজায় সহযোগিতা করে। “আমরা নারীরা জানাজার সারিতে দাঁড়াইনি। দাঁড়িয়েছিলাম জানাজার চারপাশ ঘিরে, যাতে কেউ হামলে না পড়ে,” লেখেন মুনা।

এরপর আশুরার তাজিয়া মিছিলকে কেন্দ্র করে মাতম মিছিলের আয়োজন করা হয়। বানানো হয় শোকের ব্যানার ও মাথার ফেট্রি। শিল্পী জাহিদ হৃদয় আন্দোলনকারীদের গায়ে লিখে দেন হয়—“হায় সাঈদ”, “হায় ওয়াসিম”, “হায় রাফি”।

“সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গণের শিল্পী অমল আকাশের সঙ্গে আমরা তাজিয়ার আদলে বুক চাপড়ে শুরু করি আমাদের মাতম মিছিল। সেই মিছিল, সেই মাতমে কেঁপে উঠেছিল শহর। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম—সবাই একত্র হয়েছিল এক প্রান্তে, এক আর্তনাদে,” লেখেন ফারহানা মানিক।

সেদিনই ঘোষণা দেওয়া হয় পরবর্তী দিনের কর্মসূচি এবং শপথ। 
মুনা তাঁর স্মৃতিচারণের শেষে লেখেন,“জুলাই অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে আমরা একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা ও জুলাইয়ের আত্মত্যাগের পতাকা আবারও তুলে ধরব।

“আজ নয়তো কাল—আমরা সেই বাংলাদেশ গড়বই,
যে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল একাত্তরে,
এবং যা গর্জে উঠেছিল জুলাইয়ে।”

সর্বশেষ

জনপ্রিয়