১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতা টিপুর বক্তব্যে সমালোচনার ঝড়

বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতা টিপুর বক্তব্যে সমালোচনার ঝড়

শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের ‘আল-বদর, আল-শামস’ নয় পার্শ্ববর্তী দেশের লোকেরা হত্যা করেছে” এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। এমন খোদ বিএনপির নেতারাও তার বক্তব্যের সাঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে নিন্দা জানিয়েছে।

রবিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, “১৪ ডিসেম্বর কোনো আল-বদর, আল-শামস সেদিন আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেন নাই। সেদিন পার্শ্ববর্তী কোন এক দেশের লোকেরা পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ বেঁধেছিল সেটাকে টার্গেট করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।”

বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য ‘একটি রাজনৈতিক দলকে’ দায়ি করা হলেও তা সঠিক ইতিহাস নয় উল্লেখ করে এ বিএনপি নেতা ওই রাজনৈতিক দলটিকে বর্তমান সরকারের কাছে ‘ইতিহাস সংশোধনের দাবি’ জানানোর আহ্বানও জানান।

‘১৪ ডিসেম্বর তো কোনো আল-বদর, আল-শামস সেদিন আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেন নাই’- উল্লেখ করে এ বিএনপি নেতা বলেন, “হত্যা করেছিল (তারা), যারা সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হবে কি হবে না, বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করতে চেয়েছিল। যারা দেশ স্বাধীন হতে দিবে কি দেবে না..। সেদিন পার্শ্ববর্তী কোনো এক দেশের লোকেরা পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ বেঁধেছিল সেটাকে টার্গেট করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।”

জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ্য করে এ বিএনপি নেতা বলেন, “আমি মনে করি, ইসলামিক দলগুলো যাদেরকে টার্গেট করে বিভিন্ন বাম-সংগঠন, বাম-মনা সাংবাদিকরা এখনো আপনাদেরকে টার্গেট করে কথা বলে, আর ইতিহাসের পাতায় আপনাদেরকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। কেন আপনারা এটা সংশোধন করেন না, কেন আপনারা দাবি জানান না? শুধু কোনো জায়গায় স্টেজে উঠলেই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে, বিএনপির বিরুদ্ধে (কথা) বলেন কিন্তু কোনোটা প্রমাণ করতে পারেন না। অতএব রাজনৈতিক ইসলামিক দল, এখানে কাদেরকে বলছি, উনারা ভালো করে বুঝতেছেন।”

এ সময় সভায় উপস্থিত জামায়াতের মহানগরের আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার ওই বিএনপি নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আগামী সরকারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচনার দাবি জানাই।”

তাকে থামিয়ে দিয়ে টিপু বলেন, “বিগত ১৬ বছর বা এর আগে স্বাধীনতার পর অনেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল...অতএব সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্যই আমি আহ্বান করছি। পাশাপাশি এই বক্তব্যে কারও যদি গাত্রদাহ হয়, তাহলে আগামীতে বক্তব্য দেওয়ার সময় আপনারাও বিএনপির যাতে গাত্রদাহ না হয় সেইদিকে খেয়াল করে বক্তব্য দিবেন।”

জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবির সভাপতিত্ব সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, মহানগর জামায়াতের সাবেক আমীর মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল ইসলাম, এনসিপির জেলা কমিটির সমন্বয়কারী আব্দুল্লাহ আল আমিন, ইসলামী আন্দোলনের মহানগর সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, গণঅধিকার পরিষদ জেলা সভাপতি মো. নাহিদ প্রমুখ।

সভায় এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ বা বিরুদ্ধমত প্রকাশ না করলেও পরে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি নেতা টিপুর বক্তব্যের প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানান।

মুঠোফোনে এনসিপি নেতা আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেন, “টিপু ভাই যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন আমি আর রাজিব (জেলা বিএনপি নেতা) ভাই পাশাপাশি বসা ছিলাম। আমরা দু’জনই তখন খুবই অবাক হয়েছি। নিজেরাও এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম যে, ‘উনি এ ধরনের বক্তব্য কীভাবে দিলেন!’ আমাদের খুব অবাক করেছে তার বক্তব্য।”

“প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে ধারণার উপর ভিত্তি করে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন না। অনেকেই মনগড়া ইতিহাস বানাতে চাচ্ছে কিন্তু ওনার (টিপু) মতো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এই ধরনের বক্তব্য আসবে, তা আমরা এক্সপেক্ট করিনি। ওই সভায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে এমন চিন্তা করে আমরা সরাসরি প্রতিবাদ না জানালেও, কোনোভাবেই এই বক্তব্যকে সমর্থন করা যায় না। সভা শেষে টিপু ভাইকেও আমরা এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের কথা বলেছি।”

“মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারীদের দায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের। এইখানে কোনো বিতর্কের সুযোগ নাই। যদি কোনো বিতর্ক (ভবিষ্যতে) একাডেমিকলি তৈরিও হয়, তাও প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে”, যোগ করেন এনসিপি নেতা।

সভায় উপস্থিত গণসংহতি আন্দোলনের নেতা তরিকুল ইসলাম সুজন বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন দেশের মেধাবী সন্তানদের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক-হানাদার বাহিনী, আল-বদর, আল-শামসের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক ও লেখকদের হত্যা করেছে। যারা আজ এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, হয় তাদের ইতিহাস-জ্ঞান সীমিত, নয়তো তারা সচেতনভাবে দেশ-বিরোধীদের পক্ষাবলম্বন করছে।”

“মুক্তিযুদ্ধে বিএনপির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে। ইতিহাস বিকৃতির এই অপচেষ্টা অনাকাক্সিক্ষত। অতীতে ইতিহাসকে আওয়ামী লীগ দলীয়করণ করেছে, আজ দলীয়করণ নয়, কেউ কেউ ইতিহাসের মিথ্যাচার করছে।”

সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে আবু আল ইউসুফ খান টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রোববার দেওয়া বক্তব্যের সাফাই দেন এবং বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মতামত, দলীয় নয়।

“পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের চিনতো না। তখন যুদ্ধটাকে আরও উস্কে দিতে এবং দেশকে মেধাশূণ্য করতে তৃতীয় একটি পক্ষ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। আমি বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু করি, ইতিহাসের বই-পত্র ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাতেই আমি এমন তথ্য পেয়েছি।”

তবে, নিজ দলের সদস্য সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। ওই সভাতে সাখাওয়াত নিজেও উপস্থিত ছিলেন।

মুঠোফোনে তিনি বলেন, “আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত না। এবং দলও এই কনসেপ্টের সঙ্গে একমত না।”

দলীয় নেতার এমন বক্তব্যের বিষয়টি জ্যেষ্ঠ নেতাদের নজরে আনা হয়েছে এবং তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান সাখাওয়াত।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়