নারায়ণগঞ্জে নিরাপত্তা শঙ্কায় রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীরা
ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা। জেলাজুড়ে হত্যাকান্ড, অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শনী, জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার না হওয়া এবং নিয়মিত সন্ত্রাসী মহড়া ও সংঘর্ষ তাদের এই শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এমনকি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতারও আশঙ্কা সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীদের। কেউ কেউ ‘গুপ্ত রাজনীতিও’ দৃশ্যমান হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। তারা প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
তাদের দাবি, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি, প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকার ও প্রশাসনের প্রধান কাজ।
গত রোববার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভাও এসব শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ওই সভায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
সভায় জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব বলেন, “চব্বিশের পর আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীনভাবে কথা বলবে, চলাফেরা করবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে পরিলক্ষিত হচ্ছে- অনেক সাহসী মানুষও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। গুপ্ত রাজনৈতিক ঐতিহ্য দৃশ্যমান হচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি খুবই সীমিত পরিসরে দৃশ্যমান। দু-চারটি অস্ত্র উদ্ধার হলেও মানুষের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।”
‘নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা’ প্রকাশ করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, “ঢাকার মতো ঘটনা ওই গডফাদার, দোসররা নারায়ণগঞ্জেও যে ঘটনাবে না, তা আমরা বলতে পারি না।”
এ সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক রায়হান কবির। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক আল মেহেদী, জেলা সিভিল সার্জন মুশিউর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলমগীর হুসাইনসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
গণসংহতি আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনীত প্রার্থী ও দলটির জেলা সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন বলেন, “ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহু মানুষের সাথে আমি এই ইলেকশনটা আসলে কেমন হবে সেটা নিয়ে কথা বলে এসেছি। তাদের কথা হচ্ছে আগের ইলেকশনগুলো যেমন হয়েছে তেমনই হবে। অর্থাৎ এইটা মানে দখল কিংবা পেশি শক্তি টাকা সবটাই বহাল থাকবে। আমরা যদি পরিবর্তন আশা করি তাহলে কাঙ্খিত পরিবর্তন এখনই তারা কেউ দেখতে পাচ্ছেন না এবং সত্যিকার অর্থে আমি নিজেও দেখতে পাচ্ছি কিনা।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে অভ্যুত্থানকে এক অংশ একটা সুযোগ হিসেবে দেখেছেন এবং এই সুযোগ থেকে নানান অংশের সুযোগ-সুবিধা সবটাই তারা নিয়েছেন এবং আমরা দেখব যে, এই রাষ্ট্রের কোথাও কিন্তু কোন অংশের পরিবর্তন হয় নাই। কেবলমাত্র ব্যক্তি বিশেষের একটা পরিবর্তন এসেছে।”
জামায়াতে ইসলামীর নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী ও দলটির মহানগর শাখার আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্টদের লোকজন এলাকায়-এলাকায়, বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে কোন সাহসে মানুষকে ভয়ভীতি দেখায় এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা প্রত্যাশা করবো, আপনারা এগুলোর খোঁজখবর রাখবেন। এবং কার হাত কত বড় হাত লম্বা সেটাও দেখবেন।”
এ সময় তারা প্রশাসনকে আরও তৎপর এবং জুলাই আন্দোলনে লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারের প্রতিও তাগিদ দেন।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জেলার বিভিন্ন থানা থেকে ১৫১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র এবং ৯ হাজার ২৫ রাউন্ড গুলি লুট হয়। যার মধ্যে ১১১টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৫০৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু বাকি ৪০টি অস্ত্র এবং প্রায় ৭ হাজার ৫১৮ রাউন্ড গুলির কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে একের পর এক ঘটনায় প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। এসব ঘটনায় সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের ছবি-ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনারই অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে হামলার মুখেও পড়তে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করা বন্ধন পরিবহনের দখল নিতে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। ওইদিন দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শনের পাশাপাশির আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিও চলে বলে জানান স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা। থানার মাত্র একশো মিটার দূরে এই ঘটনা ঘটলেও অস্ত্রধারীদের গত এক বছরেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
চলতি বছরের ৬ মার্চ সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন।
গত নভেম্বর মাসেও শহরের বিভিন্ন এলাকায় পরপর চারটি গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে এক ঘটনায় এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হন। ১৫ নভেম্বর শহরের মাসদাইরে মোবাইল ফোন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে কৃষকদল নেতা নাহেদুর রহমান পারভেজকে মারধর, ছুরিকাঘাত এবং প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। সিসিটিভি ফুটেজে এক ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। হামলার পরদিন র্যাব অভিযানের প্রস্তুতি নিলে জাহিদ ও তার সহযোগীদের গুলিতে জবা আক্তার (২২) নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হন।
গত ১৮ নভেম্বর রাত আটটার দিকে সোনার বাংলা মার্কেটের পেছনের গলিতে ইন্টারনেট ব্যবসার বিরোধের জেরে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়ার উপর হামলা ও প্রকাশ্যে গুলি ছোড়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন সন্ত্রাসী তাকে মারধর করে মাটিতে ফেলে দেয় এবং পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হননি।
এদিকে, কয়েকদিন আগে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ডে এনসিপির প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল আমিনের পোস্টার সাঁটাতে গিয়ে মারধরের শিকার হন দলটির তিনজন কর্মী। তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত করেন দুর্বৃত্তরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও তদন্ত) তারেক আল মেহেদী বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সর্বোচ্চ জোরদার করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া বেশকিছু অস্ত্র আমরা উদ্ধার করেছি। বাকিগুলোও উদ্ধারে কাজ করছে বিভিন্ন বাহিনী। সন্ত্রাসীদেরও অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং হবে।”
রাজনৈতিক নেতাদের অভয় দিয়ে তিনি বলেন, “যারা রাজনীতিবিদ আছে আপনারা নিশ্চিন্তে প্রচারণা চালিয়ে যাবেন। আমরা সবধরনের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা দিতে প্রস্তুত।”





































