২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান

প্রকাশিত: ২১:৩৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দুর্গোৎসব: আলো ঝলমলে মণ্ডপে শিল্প-ঐতিহ্যের মেলবন্ধন

দুর্গোৎসব: আলো ঝলমলে মণ্ডপে শিল্প-ঐতিহ্যের মেলবন্ধন

জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান: আলো আর রঙের বর্ণিল সাজে উৎসবের আমেজে ভরপুর নারায়ণগঞ্জ। শহরের গলি থেকে মহল্লা- সবখানেই চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা, প্রতিমা নির্মাণ আর আলোকসজ্জার ব্যস্ততা। দু’দিন পর দেবী দুর্গার আগমনে নগরী রূপ নেবে এক উৎসবমুখর শহরে। ভক্ত-জনসাধারণের পদচারণায় ভরে উঠবে প্রতিটি মণ্ডপ, বাজবে ঢাক-ঢোলের তাল, আর বাতাসে ভেসে আসবে আনন্দ আর ভক্তির মিশ্র সুর।

ঐতিহ্যের ধারায় মাটির ঘ্রাণ, পাটের বুনন কিংবা শিল্পীর তুলির টানে গড়ে উঠছে প্রতিটি পূজামণ্ডপ, যেন একেকটি শৈল্পিক নিদর্শন। কোথাও দেবীকে সাজানো হচ্ছে জামদানী শাড়িতে, কোথাও আবার যোদ্ধার রূপে অসুরবিনাশীর প্রতীক হিসেবে। সব মণ্ডপের লক্ষ্য একটাই- দেবীকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দঘন ক্ষণকে করে তোলা স্মরণীয়। ধর্মীয় আচার ছাড়িয়ে এই উৎসব এখন রূপ নিয়েছে সংস্কৃতি আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহোৎসবে।

এদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এ উৎসবকে কেন্দ্র করে যেকোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আয়োজিক কমিটির নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো থাকছেই।

শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে কয়েকটি পূজামণ্ডপ ঘুরে কারিগরদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দেখা যায়। মণ্ডপগুলোকে সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে। প্রতিমায় লাগানো হচ্ছে গহনা, লাগছে রং তুলির আঁচড়। সেইসাথে প্যান্ডেল নির্মাণ এবং সাজসজ্জার কাজে শিল্পী ও কারিগররা পার করছেন ব্যস্ত সময়।

আয়োজকদের কেউ কেউ নির্দিষ্ট থিমকে ঘিরে মণ্ডপ সাজিয়েছেন। অনেকে পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে রীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে, প্রতিটি মণ্ডপে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা ছিল লক্ষনীয়।

শহরের নিতাইগঞ্জের শ্রী শ্রী বলদেব জিউর আখড়া ও শিব মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, দেশীয় ঐতিহ্যেকে গুরত্ব দিয়ে মন্দির কমিটি দেবীকে সাজিয়েছে দেশীয় শিল্পীদের তাঁতে বুনন করা জামদানী শাড়ি। প্রতিমার প্রতিটি রেখায় ফুটিয়ে তুলেছে দেশীয় উপাদান।

মন্দিরেও বাইরেও চলছিল সজ্জার কাজ। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রেখেছে সেলফি তুলে পুরস্কার জিতে নেওয়ার সুযোগও রেখেছে আয়োজক কমিটি। এতে সহযোগী হিসেবে রয়েছে দেশীয় একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড।

মন্দির কমিটির সভাপতি জয় কে রায় চৌধুরী বলেন, “আমরা এইবারের পূজায় দেশীয় পোশাকে গুরুত্ব দিয়েছি। মন্দিরের সজ্জাতেও দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করেছি।”
এখন দর্শনার্থীদের বরণ করে নেওয়ার জন্য শেষ মূহুর্তের কাজ চলছে বলেও জানালেন জয়।

নারায়ণগঞ্জের ১৪৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী আমলাপাড়া সার্বজনীন পূজা মণ্ডপ প্রতিবছর দর্শনার্থীদের বিশেষ আকর্ষণ থাকে। এবারও আয়োজকরা মণ্ডপে রেখেছেন ভিন্নমাত্রার ছোঁয়া। মাটির ঘ্রাণ, বাঁশের ডিজাইন, পাটের বুনন আর গ্রামীণ নকশা মণ্ডপটিকে দিয়েছে আবহমান বাংলার নান্দনিক চেহারা। প্রতিমার প্রতিটি রেখায় ফুটে উঠেছে গ্রামের সহজ-সরল জীবন। এখানে পূজা মানেই শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রাকৃতিক উপাদানের দিকে।

অন্যদিকে বরাবরের মতোই শৈল্পিক রূপে সেজেছে উকিলপাড়া হোসিয়ারী পূজা কমিটি। দেবীকে পড়ানো হয়েছে লেহেঙ্গা এবং সাজানো হয়েছে ডিজাইন করা গহনা দিয়ে। প্রতিমার সজ্জায় শিল্পীর নিখুঁত স্পর্শ দর্শনার্থীর মনে জাগিয়েছে গর্ব আর ভক্তির মিশ্র আবেগ। এই মণ্ডপের কাজ শেষ, সবাই এখন দেবীকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়।

নিতাইগঞ্জের প্রজন্ম প্রত্যাশা পূজা উদযাপন কমিটি এ বছর তাদের ৩০তম বার্ষিকী পালন করছে। এ উপলক্ষে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে বর্ণিল রঙে, সেই সাথে নির্মিত হয়েছে নান্দনিক ডিজাইনের বিশাল তোরণ, যা মণ্ডপের বিশেষ আকর্ষণ।

সাহাপাড়া সার্বজনীন পূজামণ্ডপেও চলছে শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জা। কারিগররা ব্যস্ত মণ্ডপের আশপাশের ডেকোরেশন নিয়ে। এবারের প্রতিমায় দেবীকে ঘরে আনা হচ্ছে হাতির পিঠে, যা অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক। পাশাপাশি তারা পরিবেশের কথা চিন্তা করে প্লাস্টিক ব্যবহার যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করছে।

নয়ামাটি গিরিধারী মন্দিরের পূজামণ্ডপ এবার দেবীকে সাজাচ্ছে রণক্ষেত্রের যোদ্ধার রূপে। অসুররূপী শক্তি বিনাশের প্রত্যয়ে প্রতিমাকে দেওয়া হয়েছে বড় চুলের সাজ, আর প্রতীকীভাবে নির্মিত হয়েছে শিবের অনুচর গজা অসুরের দুইভাগ হওয়া মূর্তি।

মণ্ডপের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা প্রদীপ ঘোষ ঝন্টু বলেন, “আমরা এবারে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেছি। দেবীকে যোদ্ধার রূপে আবির্ভূত করেছি এবং গজা অসুরের দুইভাগ করা মূর্তি তৈরি করেছি।”

এসব পূজা মণ্ডপ ও মন্দির শুধু ধর্মীয় আচার পালনের স্থান নয়, স্থানীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। তবে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় আলোকসজ্জা আর মণ্ডপসজ্জাকে ঘিরে তৈরি হয় প্রতিযোগিতা। প্রতিটি মণ্ডপের ব্যয় (আলো, প্রতিমা, সজ্জাসামগ্রী) বহনে অনেক কমিটি নির্ভর করে জনস্বেচ্ছা বা দাতাদের উপর। সরকারি সহায়তা ও অনুদানও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত রাখা এবং শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জেলায় ২২৪টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭৯টি, বন্দর উপজেলায় ২৯টি, রূপগঞ্জে ৪৪টি, সোনারগাঁয়ে ৩৫টি এবং আড়াইহাজারে ৩৬টি মণ্ডপে পূজা হবে। প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আনসার সদস্য, মণ্ডপ কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা, পর্যাপ্ত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যও মোতায়েন থাকবে।

নারায়ণগঞ্জ শহরজুড়ে এখন আলো-আনন্দে ভরপুর প্রাণচাঞ্চল্য। সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা অপেক্ষায় আছেন দেবীকে ঘরে আনার। ধর্ম ও সংস্কৃতির রূপে শারদীয় দুর্গোৎসব হয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন। আর এই নগরী রূপ নিচ্ছে এক বিশাল উৎসবমঞ্চে।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়