১৯ অক্টোবর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:২৮, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

তেল মেপে কোটিপতি ‘ব্রাজিল বাড়ি’র টুটুল

তেল মেপে কোটিপতি ‘ব্রাজিল বাড়ি’র টুটুল

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাড়ি জয়নাল আবেদীন টুটুলের। বিশ্ব ফুটবলে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের পতাকার রঙে পুরো বাড়ি সাজিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসা টুটুলের অবৈধ উপার্জনের ফিরিস্তি উঠে এসেছে দেশের জাতীয় একটি দৈনিকের অনুসন্ধানে। সরকার নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা ওয়েল কোম্পানিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরি করা এ ব্যক্তি গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ‘ব্রাজিল বাড়ি’ খ্যাত তার ফতুল্লার বাড়িটি যার অন্যতম উদাহরণ। 

অনুসন্ধানে জয়নাল আবেদীন টুটুলের অবৈধ আয়ে কেনা জমি, ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ তিনি গড়েছেন সরকারি ডিপোর তেল চুরি ও দুর্নীতির মাধ্যমে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে দীর্ঘ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার সঙ্গে অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমনকি হত্যা মামলার আসামি হয়ে অফিস না করলেও টুটুলের নামে উপস্থিতির স্বাক্ষর ওঠে খাতায়।

টুটুলের বাবা মো. রফিক তেল কোম্পানি যমুনার ফতুল্লা ডিপোতে দারোয়ানের চাকরি করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ক্যানটিনের কর্মচারী হিসেবে ‘কাজ নাই, বেতন নাই’ ভিত্তিতে চাকরি পান টুটুল। ২০০৫ সালে সাধারণ কর্মী হিসেবে চাকরি স্থায়ী হয়। অল্প সময়েই তিনি হয়ে যান গেজার (যাঁর কাজ তেল মাপা)। কোম্পানিতে টুটুলের মূল বেতন ২০ হাজার ৩১০ টাকা। ভাতা, সুযোগ-সুবিধাসহ সব মিলে বেতন হয় ৫০ হাজার ৫০০ টাকা। সীমিত বেতনের এই কর্মচারী এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

যমুনার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, তেল মাপার মধ্যে আছে হিসাবের বড় ফাঁকি; যা কাজে লাগিয়ে জয়নাল বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ফতুল্লার ব্রাজিল বাড়ির পাশেই টুটুলের নিজের কেনা ৫ শতাংশ জমিতে আরও একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য তার দুটি বাল্কহেড জাহাজ ও দুটি ট্যাংক লরি রয়েছে। নিত্য ব্যবহারের জন্য টুটুল প্রিমিও মডেলের একটি প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালিতে চাচার নামে একটি দ্বিতল বাড়ি, পুকুর রয়েছে। ওই বাড়িতে একটি কক্ষ আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, গ্রামে গেলে এ কক্ষে থাকেন তিনি।

গ্রামের বাড়ির সামনেই কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত হচ্ছে একটি দ্বিতল মসজিদ, যার অধিকাংশ অর্থায়নও তিনি করেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সরকারি তেল কোম্পানিতে চাকরি করে ব্যবসা করার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও খুলনায় বাবার নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আত্মীয়দের নামে এবং নিজের ব্যবসাও রয়েছে তার।

টুটুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে জমি ও ফ্ল্যাট আছে বলেও ফতুল্লা ডিপো এবং যমুনা তেল কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে।

টুটুলরা তিন বোন ও দুই ভাই। তিন বোনের তিন স্বামীর মধ্যে দুজন এখন ফতুল্লায় যমুনার ডিপোতে চাকরি করেন, একজন স্থায়ী ও অন্যজন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। তাঁর আরেক ভগ্নিপতি ও ছোট ভাই ব্যবসা (টুটুল ও নিজেদের) দেখাশোনা করেন। তাঁদেরসহ আত্মীয়স্বজনের নামে টুটুলের সম্পদ আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে জয়নাল আবেদীন টুটুলের দাবি, ঢাকায় তার কোনো ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই। ভাইবোনদের সহযোগিতা, খুলনায় বাবার (ফরিদ মোটরস) ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয় ও পেনশন এবং ব্যাংকঋণের টাকা দিয়ে ব্রাজিল বাড়ি বানানো হয়েছে।

তেল ডিপো বা কোম্পানি থেকে সাধারণত তেল চুরি হয় দুভাবে। প্রথমত, উচ্চ তাপমাত্রার কারণে তেল পরিমাণে বেড়ে যায়। এই বাড়তি তেল হিসাবে দেখানো হয় না। চুরি করা হয়। দ্বিতীয়ত, তেলের একাংশ বিক্রি করে তা ভেজাল মিশিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়।

পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা- সরকারি এই তিন তেল কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে ভুয়া হিসাব দেখিয়ে জ্বালানি তেল চুরি করে বিক্রির একটি চক্র তৈরি হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত এ চক্রে। এর মূলে আছেন জয়নালের মতো তেল কোম্পানির শ্রমিক সংগঠনের (সিবিএ) কয়েকজন নেতা, যাঁরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

গত এক দশক ধরে যমুনা অয়েল কোম্পানি লেবার ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি টুটুল। বিগত সরকারের সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ হন তিনি। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পরও আড়াল থেকে ডিপো নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ আছে। এখন তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়