২২ মে ২০২৫

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ১৭ আগস্ট ২০১৯

আপডেট: ১৬:৩৩, ১৮ আগস্ট ২০১৯

বন্দরে সিমু আনন্দধাম বৃদ্ধাশ্রমের নামে প্রতারণা!

বন্দরে সিমু আনন্দধাম বৃদ্ধাশ্রমের নামে প্রতারণা!
চিহ্নিত নারী হাসিনা রহমান সিমুর আপন খালা লাকি বেগম

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: সহায় সম্বলহীন কিংবা নিজ সংসারে অবহেলিত অসহায় প্রবীণদের কারও কারও শেষ আশ্রয়স্থল বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে তাদের থাকা, খাওয়া এবং পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করেই প্রতারণা করছে বন্দরের সিমু আনন্দধাম বৃদ্ধাশ্রম। স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রেস নারায়ণগঞ্জের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এমন তথ্য।

বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জের কদম রসূল এলাকায় গরীব, অসহায়, আশ্রয়হীন, কর্মক্ষমহীন বয়স্ক নারীদের আশ্রয়ের লক্ষ্যে এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হলেও উদ্বোধনের পর থেকেই সেখানে থাকছেন না কোন বৃদ্ধা। উদ্বোধনের সময় যেসব বৃদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল তাদের উদ্বোধনের পরেই আশ্রম থেকে বের করে দিয়েছেন আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা ও জেলা মহিলা শ্রমিক লীগের নেত্রী হাসিনা রহমান সিমু। আশ্রমে কোন আশ্রিতাই থাকেন না।

শনিবার (১৭ আগস্ট) সরেজমিনে বৃদ্ধাশ্রমটিতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের একটি ঘরের সামনে সিমু আনন্দধাম বৃদ্ধাশ্রমের সাইনবোর্ড লাগানো। ঘরে প্রবেশ করতেই দুই পাশে দু’টি চৌকি দেখা যায়। যার উপরে কোন তোষক ছিল না। কেবলমাত্র একটি পাটি বিছানো যার উপরে একটি চাদর পাতা। এই চৌকিতে দশ-বারোজন ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কোন বৃদ্ধা সেখানে ছিলেন না। এমনকি ঘরের ভেতর কোন জামা-কাপড়, আসবাব, জগ কিংবা গ্লাস কিছুই দেখা যায়নি।

এমন সময় ঘরে ঢোকেন হাসিনা রহমান সিমু। পাশেই তার বাবার বাড়ি। সেখানেই থাকেন তিনি। এ সময় সিমু ঘরে আড্ডা দেওয়া ছেলেদের চলে যেতে বললে তারা চলে যান।

পরে হাসিনা রহমান বলেন, এখন এখানে আশ্রিত হিসেবে চারজন থাকেন। কিন্তু এখন কাউকে পাওয়া যাবে না কারণ তারা ঈদের ছুটিতে নিজের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন।

তিনি জানান, আশ্রিতা চারজনের দুই জন অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাকি দুইজন ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দিন শেষে রাতে এসে তারা এই বাড়িতে থাকেন। তাদের থাকা-খাওয়ার যাবতীয় খরচ তার সামাজিক প্রতিষ্ঠান আনন্দধাম বহন করে। তিনি এই সংগঠনটির নির্বাহী চেয়ারম্যান। এছাড়া হাসিনা অটিজম চাইল্ড কেয়ার নামেও একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তিনি।

কর্মক্ষম এবং আশ্রয় যাদের আছে তারা বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিতা হিসেবে কেন থাকবেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তাদের যখন নিজেদের বাড়িতে থাকতে বিরক্তি চলে আসে তখন তারা এখানে এসে থাকেন। এখানে এসে বিশ্রাম নেয়। পার্মানেন্টভাবে তারা এখানে থাকেন না।

চলতি বছরের ১০ জুন সিমু আনন্দধাম বৃদ্ধাশ্রমটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাব্বি মিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি না আসাতে আশ্রমটির উদ্বোধন করেন জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ। এ সময় জেলা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলী (পিপি) এড. ওয়াজেদ আলী খোকনসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনের দিন আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা হাসিনা রহমান সিমু জানান, আশ্রয় সেবা প্রকল্পটির প্রাথমিক অবস্থায় ৫টি ইউনিটে ২০ জন আশ্রয়হীন বৃদ্ধাকে দৃশ্যমান ও আরো ১০ জনকে অদৃশ্যমান রেখে মোট ৩০ জনকে আশ্রয়ের আওতায় রেখে কার্যক্রম শুরু করা হবে। পরবর্তীতে প্রতি ইউনিটে ৪ জন করে ২৫টি ইউনিটে ১শ’ জনকে আশ্রয়ের আওতায় রাখা হবে।

এই বৃদ্ধাশ্রমের আশ্রয়গ্রহীতাদের সহযোগিতায় তিনি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠানটি গড়তে খাস জমি বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছেও দাবি জানান হাসিনা রহমান সিমু।

উদ্বোধনের দিন কাজী বেগম (১১৫) ও তাম্বিয়া বেগম (৭০), লাকি বেগম (৫০) নামে তিন নারীকে আশ্রিতা হিসেবে উপস্থিত অতিথি ও গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে লাকি বেগম হাসিনা রহমান সিমুর আপন খালা। নিজের খালাকে আশ্রয়হীন বৃদ্ধা সাজিয়ে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। নিজের খালাকেও তার প্রতারণার অংশ হিসেবে ব্যবহার করেন।

এদিকে প্রেস নারায়ণগঞ্জের অনুসন্ধানে জানা যায়, আশ্রিতা হিসেবে উল্লেখিত কাজী বেগম ও তাম্বিয়া বেগম নামে দুই নারীকে মূলত বৃদ্ধাশ্রমের কথা বলে অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। তাদের বলা হয়েছিল, সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের টাকা, খাবার ও কাপড় দেওয়া হবে। অনুষ্ঠান শেষেই তাদের বিদায় করে দেওয়া হয়।

কাজী বেগম ও তাম্বিয়া বেগমের সাথে আলাপকালে তারা প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমাদের টাকা দিবে বলে নিয়ে যায় সিমু। ওইদিন অনেক মানুষ আসে। সারাদিন সবার সাথে বসিয়ে রেখে সবার সাথে ছবি তুলিয়েছে। কিন্তু দিন শেষে কোন টাকা দিয়েই চলে যেতে বলেন। কেবল একটা কম দামি ম্যাড়ম্যাড়ে কাপড় হাতে দেন।

১১৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা কাজী বেগম অভিযোগ করে বলেন, দু’য়েকদিন পরপরই তিনি আশ্রমে যান কিন্তু তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

স্থানীয় এলাকাবাসী বলেন, বৃদ্ধাশ্রমটিতে কেউ থাকেন না। আশ্রমটি উদ্বোধন করতে দেখছি কিন্তু তারপর এখানে কাউরে থাকতে দেখি নাই।

এদিকে উদ্বোধনের দিন আপন খালা লাকি বেগমকে আশ্রয়হীন হিসেবে পরিচয় করানো হলেও তিনি একজন চাকুরিজীবী বলে জানা যায়। লাকি বেগম মুঠোফোনে প্রেস নারায়ণগঞ্জকে জানান, ওইদিন তাকে আশ্রিত বলে পরিচয় করানো হলেও তিনি এখন আর সেখানে থাকেন না। তিনি একটা চাকরিও করেন এবং অবসরে বাড়িতে সেলাই মেশিন চালান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাকি বেগমের মেয়ে পরিচয়ে মুঠোফোনে এক নারী বলেন, সেদিন মা গিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেখানে থাকেন না। আমরা থাকতে মা সেখানে থাকবে কেন? মাঝে মাঝে ঘুরতে যান। কিন্তু মা সেখানে থাকেন না।

পরে মুঠোফোনে হাসিনা রহমানের কাছে তাম্বিয়া বেগম, কাজী বেগম ও লাকি বেগম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, তারা যখন এসব কথা বলেছে তাহলে তাদেরই জিজ্ঞেস করুন। আমি কিছু বলার নেই এ বিষয়ে।

প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম

সর্বশেষ

জনপ্রিয়