২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

সৌরভ হোসেন সিয়াম

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫

গরম ভাত খাওয়া হলো না আলিফার: মায়ের আর্তনাদ

গরম ভাত খাওয়া হলো না আলিফার: মায়ের আর্তনাদ

তখনও দুপুরের ভাত চুলায়। রান্না শেষ না হওয়ায় মা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে প্ল্যাস্টিকের বস্তা নিয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রতিবেশীর বাসায়। তারপর গরম ভাত নিয়ে অপেক্ষা থাকা মা আর পাননি শিশু কন্যার খোঁজ। পরদিন সকালে পাশের একটি বাড়ির দরজার সামনে মেলে ১৩ বছর বয়সী ওই শিশুর মরদেহ।

কন্যার শোকে পাগলপ্রায় নাসিমা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আমার নাবালক শিশু। মাইয়াটায় দুপুরে খায় নাই। তারে মাইরা ফেলছে। আমি মাইনষের বাইত থাল-বাসুন ধুইয়া মাইয়ারে পালছি। আমার সেই নাবালক শিশুটারে যে মারছে হের ফাঁসি চাই আমি।”

কথা শেষ করার আগেই মুর্ছা যান তিনি।

পেশায় গৃহকর্মী নাসিমার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা মোসা. আলিফা শনিবার বিকেল আনুমানিক চারটার দিকে বাড়ির সামনে থেকে নিখোঁজ হন। পরদিন রোববার সকালে তার মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। পাশেই পড়া ছিল প্ল্যাস্টিকের বস্তাটিও।

আলিফা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বন্দর অঞ্চলের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের দড়ি সোনাকান্দা এলাকার বাসিন্দা মো. আলী ও নাসিমা দম্পতির বড় কন্যা। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরের ধলাগাঁও গ্রামে। অন্তত দশ বছর যাবৎ দড়ি সোনাকান্দা এলাকায় ভাড়াবাসায় থাকেন তারা।

এ দম্পতির ৮ বছর বয়সী আরও এক কন্যা রয়েছে।

আলিফার বাবা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালক মো. আলী বলেন, বিকেলে গাড়ি গ্যারেজে দিয়ে বাসায় ফেরার পর সন্তান নিখোঁজ বলে জানতে পারেন। রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেও সন্তানের সন্ধান পাননি।

স্থানীয় দু’টি মসজিদে মাইকিংও করা হয় বলে জানান তিনি।

বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মুক্তার আশরাফ বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে পুলিশ সকালে মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়।

“শিশুটির পরিবার যে ভাড়াবাড়িতে থাকেন তার পেছনে আরেকটি বাসার দরজার সামনে শিশুটির মরদেহটি পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে শিশুটির মুখমন্ডলের আঘাত ও অন্যান্য আলামত দেখে সে মৃত্যুর পূর্বে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করছি।”

এদিকে, শিশুটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর বিকেলে মুঠোফোনে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. জহিরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, “শিশুটির গালে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এগুলো মানুষের নখের মতো বলে ধারণা করছি। এছাড়া, শিশুটি ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন কিনা তা জানতে আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে।”

“ময়ানতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে”, যোগ করেন এ চিকিৎসক।

সরেজমিনে দড়ি সোনাকান্দা এলাকায় গেলে সেখানে প্রতিবেশীরাও আলিফার মৃত্যুতে শোকাহত বলে জানান। তারা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়িদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারও দাবি করেন।

যে বাড়ির দরজার সামনে আলিফার মরদেহ পাওয়া যায় সেই ঘরটি আক্তার হোসেনের। তার ভাই ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ইস্রাফিল ইসলাম দাবি করেন, আক্তার হোসেন ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবার সময়ও মরদেহটি দেখতে পাননি। নামাজ শেষে ফেরার পর তার ঘরের সামনে শিশুটির মরদেহ দেখতে পান।

“আমার ভাই তখন ডাক-চিৎকার দিলে আমরা বেরিয়ে আসি। তখন শিশুটির পরিবারের লোকজনকেও খবর দেওয়া হয়। এবং তারা এসে জানান, লাশটি আলিফার।”

এ ঘটনার পর আক্তার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানান ইস্রাফিল।

এ প্রতিবেদক স্থানীয় অন্তত দশজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের ভাষ্য, দড়ি সোনাকান্দা এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবীদের অবাধ বিচরণ রয়েছে। অনেকের ধারণা, মাদকসেবীদের কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

সিটি কর্পোরেশনের সাবেক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর শিউলী নওশাদ বলেন, “এইখানে মাদকের ছড়াছড়ি। স্থানীয় পঞ্চায়েতকে নিয়ে এ ব্যাপারে একাধিকবার আমরা বসেছি। কিন্তু আমাদের কেউ মানে না। উল্টো ভয়ভীতি দেখায়। আমরা সন্দেহ করতেছি, মাদকসেবী কেউ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। শিশু কন্যার সাথে এই রকম নির্মম কাজ স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে না।”

কিন্তু এলাকাটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত না থাকায় ঘাতকদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

চলতি মাসে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিল নিহত আলিফা। আগামী ৩০ ডিসেম্বর ফলাফল প্রকাশের কথা। ভালো ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা শিশুটির এমন মর্মান্তিক মৃত্যু পীড়িত করছে শিক্ষকদেরও, বলছিলেন প্রাইভেট টিউটর সুলতানা রাজিয়া।

এই ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান বন্দরের ওসি গোলাম মুক্তার।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়