২১ অক্টোবর ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২০ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ২২:২৪, ২০ অক্টোবর ২০২৫

নেতায় বিভক্তি, কর্মীরা চায় ঐক্যবদ্ধ বিএনপি

নেতায় বিভক্তি, কর্মীরা চায় ঐক্যবদ্ধ বিএনপি

নারায়ণগঞ্জে বিএনপির রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিভক্তি দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জেলা থেকে মহানগর ও থানা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে আলাদা কর্মসূচি ও অবস্থান নিচ্ছে। এতে মতবিরোধ দ্বন্দ্বেও রূপ নিচ্ছে। একাধিক গ্রুপে বিভক্ত এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন ঐক্যের দাবি তুলেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে শহর ও উপজেলা পর্যায়ে দলীয় কর্মসূচি ঘিরে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও দ্বন্দ্ব চোখে পড়ছে। এতে করে সাধারণ কর্মীরা একদিকে হতাশ, অন্যদিকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন কোন নেতৃত্বের নির্দেশে মাঠে নামবেন, সেই অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জে বিএনপির এই বিভাজন নতুন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকা নেতাদের মধ্যে বিভক্তি ছিল। একই কমিটির নেতারা দলীয় কর্মসূচিও পালন করতেন পৃথকভাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। জেলা বিএনপি, মহানগর বিএনপি ও বিভিন্ন থানা কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দলটির সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করছে। মাঠ পর্যায়ে কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন দলের ভেতর ঐক্য ফিরিয়ে আনার।

নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিটে দেখা গেছে, একই কর্মসূচিতে একাধিক পক্ষ আলাদা করে কর্মসূচি দিচ্ছেন। কেউ কেউ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছাকাছি থাকার দাবি করে নিজেদের গ্রুপকে প্রভাবশালী দেখাতে চাইছেন। এর ফলে বিএনপির মূল রাজনৈতিক বার্তা জনগণের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বরং দলীয় কোন্দলে সংঘাত-সংঘর্ষ মানুষের কাছে বিএনপিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে।

দলীয়ভাবে দুর্বল হওয়ার শঙ্কা থাকলেও নারায়ণগঞ্জে বিএনপির এটাই বাস্তবতা। জ্যেষ্ঠ নেতারাও নিজেদের বলয় তৈরি করে রেখেছেন। কেবল মহানগরে নয়, উপজেলা পর্যায়েও এ বিভক্তি স্পষ্ট।

রূপগঞ্জে মনির বনাম দীপু বলয়
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি বর্তমানে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে সবচেয়ে আলোচিত রূপগঞ্জের এই দুই নেতা। সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির ও বর্তমান কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান দীপুর নেতৃত্বে দুটি বলয় গড়ে উঠেছে। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের অনুসারীদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। দু’পক্ষেরই জেলা ও প্রান্তিক পর্যায়ে সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব জনগণের কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলকে ফলবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। কাজী মনির ও দিপু ভূঁইয়া দু’জনই নারায়ণগঞ্জ-১ আসন, যেটি রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত, তার মনোনয়ন প্রত্যাশী।

আড়াইহাজারে তিন মাথা
মেঘনা নদীবেষ্টীত এ উপজেলায় তিনজন নেতার পৃথক বলয় রয়েছে। তাদের তিনজনই কেন্দ্রীয় নেতা এবং একজন আবার সাবেক সংসদ সদস্যও।

এলাকাটিতে সাবেক এমপি আতাউর রহমান আঙ্গুরের নেতৃত্বে পুরনো বলয় এখনও সক্রিয়। তবে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-অর্থনৈতিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ নিজেদের বলয় গড়ে তুলেছেন। আঙ্গুরের জনপ্রিয়তা মাঠে থাকলেও, সুমন ও আজাদের সক্রিয়তা এবং কেন্দ্রীয় যোগাযোগের কারণে তাদের গ্রুপও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। ফলে এলাকায় প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে কর্মীদের মাঝে নানা বিষয় নিয়ে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ।

এই দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন বলয়ের নেতাদের অনুসারীরা একে অপরের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষে সম্প্রতি আড়াইহাজারে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপি ও যুবদলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এছাড়াও গত বছরের ৫ আগস্টের পরেও নানা সময়ে সংঘর্ষে জড়ায় কর্মীরা।

সিদ্ধিরগঞ্জ-সোনারগাঁয়ে রেজাউল-মান্নান-গিয়াস দ্বন্দ্ব
সাবেক এমপি অধ্যাপক রেজাউল করিম ও সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপি সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পুরনো নেতারা থাকলেও, মান্নান নিজের সংগঠন পুনর্গঠন করে তরুণদের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছেন। নতুন আসন বিন্যাসের কারনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ-সোনারগাঁ নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ায়। সোনারগাঁ রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করছেন তিনি। সেই সাথে নিজ অনুসারীদের নিয়ে প্রচারণা করছেন নারায়গঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ।

ফতুল্লায় প্রার্থী প্রতিযোগিতা তীব্র
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র আকার নিচ্ছে। সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন এবং ব্যবসায়ী নেতা শাহ আলম এ আসনে আলোচনায় রয়েছেন। গিয়াসউদ্দিন অতীতে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যদিকে শাহ আলম শিল্পপতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব বলয় ধরে রেখেছেন।

এছাড়া তরুণ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজীব, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু, বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী ও যুবদল নেতা মশিউর রহমান রনি। তারা নিজ নিজ অনুসারীদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে মাঠে কাজ করছেন।

দলের এই অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা কর্মীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করলেও, অনেকেই বলছেন, দলকে শক্তিশালী করতে এখন সবচেয়ে জরুরি ঐক্য। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা আশা করছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এই আসনে কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।

সদর-বন্দরে তিন বলয়
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপি তিনভাগে বিভক্ত নেতৃত্বের অধীনে চলছে। যেখানে সবচেয়ে বড় বিভাজন দেখা গেছে।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর নেতৃত্বে মূল আহ্বায়ক কমিটি থাকলেও, বাস্তবে এটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।

সাখাওয়াত-টিপু বলয়
এই বলয়ে রয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক মনির হোসেন খান, ফহেত মোহাম্মদ রেজা রিপন, অ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ, ডা. মজিবুর রহমান, এডভোকেট এইচএম আনোয়ার প্রধান, বরকত উল্লাহ, হাবিবুর রহমান মিঠু ও ফারুক হোসেন প্রমুখ।

মাসুদুজ্জামান মাসুদ বলয়
সাবেক যুবদল নেতা ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদের এই বলয়ে রয়েছেন যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন আনু, আব্দুস সবুর খান সেন্টু,আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ফারুক হোসেন, মনোয়ার হোসেন শোখন, অ্যাডভোকেট বিল্লাল হোসেন, ফারুক আহমেদ রিপন, আলমগীর হোসেন, এডভোকেট শরিফুল ইসলাম শিপলু ও শাখাওয়াত ইসলাম রানা। তারা মনোনয়ন প্রত্যাশী মাসুদুজ্জামান মাসুদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। মাঠপর্যায়ে এই বলয় বিশেষভাবে সক্রিয়, বিশেষ করে বন্দর ও শহর অঞ্চলে।

আবুল কালাম বলয়
তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কালামের নেতৃত্বে এই গ্রুপে রয়েছেন তার ছেলে ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার আশা, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আওলাদ হোসেন ও আমিনুর ইসলাম মিঠু। নিজেদের বলয় শক্ত রাখতে আলাদা সভা ও কর্মসূচি নিয়মিত পরিচালনা করছেন।

প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ বাবুলও নিজের অনুসারীদের নিয়ে দলীয় কর্মসূচিগুলো পালন করছেন, তার ব্যক্তিগত অনুসারীদের নিয়ে। তবে, আলাদাভাবে কর্মীদের নিয়ে মাঠে রয়েছে নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ।

তবে আলাদা কর্মসূচি পালনের মধ্যেই এ বিভক্তি সীমাবদ্ধ থাকছে না, একে-অপররের সমালোচনা ও আক্রমণাত্মক কথা বলে বক্তব্য রাখছেন এবং মামলায় ফাঁসানোর মতো হুমকির ও অভিযোগ রয়েছে। এতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতির মাঠে এবং কর্মীরাও সম্মুখীন হচ্ছে নানা দ্বিধাতে।

এর আগে গত বছর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু দলীয় কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন। এই ঘটনায় তিনি বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার আশাসহ বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

তৃণমূলে ঐক্যের দাবি
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে, ত্রয়োদশ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জে বিএনপি যদি পাঁচটি আসনে জয়লাভ করতে চায়, তাহলে তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন দূর করা। সংগঠন এক থাকলে নির্বাচনী মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি শক্ত অবস্থান নিতে পারে। 

বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী মনে করেন, দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সংগঠনের ভেতরে ঐক্য ফিরিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। দ্রুত সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়ে বিভক্ত নেতৃত্বকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ বিএনপির বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, একাধিক সিনিয়র নেতা নিজেদের বলয় তৈরি করে রাখলেও, তৃণমূল এখন একটি বার্তায় ঐক্যবদ্ধ: আমরা ঐক্য চাই, বিভক্তি নয়।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়