১১ মে ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১০ মে ২০২৫

দেশজুড়ে আলোচনায় আইভীর গ্রেপ্তার

দেশজুড়ে আলোচনায় আইভীর গ্রেপ্তার

রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে স্বেচ্ছায় পুলিশের গাড়িতে গিয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বারবারের নির্বাচিত মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তার এই গ্রেপ্তারে সারাদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলেছেন বিভিন্ন রাজনীতিক, সংস্কৃতি কর্মী ও সাংবাদিকরা। তাদের কথায় উঠে এসেছে সন্ত্রাসের জনপদখ্যাত নারায়ণগঞ্জ বাস্তবতায় একজন নারী জনপ্রতিনিধির লড়াই, সংগ্রাম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন চরিত্রের বিষয়টিও।

গত বছরের জুনে সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি-নিপীড়ন-নির্যাতন চালালে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে, যা পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অস্ত্রের মুখেও মানুষের প্রতিবাদ দমাতে না পেরে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এলাকা ছেড়ে পালালেও নিজ বাড়িতেই ছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হওয়া সত্ত্বেও তার বিগত সময়ের কার্যকলাপ বিবেচনায় বিক্ষুব্দ জনতার রোষের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সবগুলো সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করার আগ পর্যন্ত বিনা বাধায় নিয়মিত অফিসও করেছেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের পদ হারানোর পর তার বিরুদ্ধে মামলা হতে শুরু করে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার চারটি এবং ফতুল্লায় একটি মামলায় আইভীকে আসামি করা হয়। এসব মামলাগুলোর ৯ মাস পর হঠাৎ বৃহস্পতিবার রাতে তার দেওভোগের বাড়িতে অভিযান চালায় জেলা পুলিশের একটি দল। তবে তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর বাধার মুখে পড়ে পুলিশ। সকালে স্বেচ্ছায় পুলিশের গাড়িতে না ওঠা পর্যন্ত তার রাতভর তার বাড়িতেই অবস্থান করতে হয় পুলিশকে।

প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান, পুলিশ যখন আইভীকে গ্রেপ্তার করতে গেলে যেসব নারী-পুরুষ বাধা দেন তাদের ভাষ্য ছিল, আইভী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকা ছিল ‘প্রতিবাদী’। সিটি কর্পোরেশনের প্রধানের চেয়ারে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় থাকলেও ‘দলবাজি’ করেননি, বরং দলমতের সকলকে সমান সুযোগ দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুবির্ষহ করে তোলা ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও সবসময় সোচ্চার ছিলেন। এ নিয়ে দলীয়ভাবেও ঝক্কি পোহাতে হলেও অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি।

আইভীর গ্রেপ্তারের পর তার এই আপোসহীন ও সাহসী ভূমিকার বিষয়টি কেবল সাধারণ জনগণের মধ্যে নয় সুশীল সমাজের আলোচনায়ও উঠে আসে। কথা বলেন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতা ও সাংবাদিকরাও।

নিজের ফেসবুকে আইভীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর পিতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি। তিনি লিখেছেন, “ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আজ সকালে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আমরা এই গ্রেপ্তারের নিন্দা জানাই। নারায়ণগঞ্জকে নরক বানিয়ে রাখা শামীম ওসমানকে সরকারের বাহিনী সসস্মানে দেশ থেকে পালাতে সহায়তা করল, তার পরিবারকে বিএনপির নেতারা পালাতে সহায়তা করল আর আইভীকে করা হলো গ্রেপ্তার। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। তিনি শামীম ওসমানকে সাথে নিয়ে হত্যা করেছেন। যে শামীম ওসমানের সাথে তার সাপ-নেউলের সম্পর্ক তাকে সাথে নিয়ে আইভী হত্যা করেছেন? একদিকে সরকার বলছে মামলা হলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তদন্ত করে প্রমাণ পেলে গ্রেপ্তার। আবার এমনি রাতভর বাড়ি ঘিরে রেখে সকালে গ্রেপ্তার।”

তিনি আরও লেখেন, “৫ আগস্টের পরে আইভীতো কোথাও পালিয়ে যান নি। নিজের বাড়িতেই ছিলেন, তাহলে রাতভার এ সবের কী প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে সরকারের কারো কারো অতি উৎসাহের কারণে, অনেক কাজে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা দেখছি সরকার অনেক কিছুই সামাল দিতে পারছে না। আইভী যতদিন চেয়ারম্যান-মেয়র ছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেন নি। দলমতের উর্ধ্বে থেকে বিএনপি জামায়াত সহ সকল দলের লোকদের সমান সহযোগিতা করেছেন। তিনি দলবাজি করে নি। দেশের বিভিন্ন পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন যে ভাবে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় হয়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে আইভী তা করেননি। আর সে জন্যই শেখ হাসিনার সুনজরে তিনি যেতে পারেন নি। ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে শেখ হাসিনা দলের সমর্থন শামীম ওসমানকে দিয়েছেন, আইভীকে নয়। আইভী সবসময় দলের লোকদের অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করেছেন। এই জন্য শেখ হাসিনা ছিলেন তার প্রতি ক্ষব্ধ। দলের প্রায় অনেকেই যখন হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাস করে চলেছে তিনি তখন তার প্রতিবাদ করেছেন। শামীম ওসমান তার বিরুদ্ধে তিনবার দুদকে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তদন্ত করে কিছু পায় নি। ৫ আগস্টের পরে দুদক আবার আইভীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এখনো কিছু পায়নি....আইভী যদি দুর্নীতি করে থাকে, হত্যার সাথে জড়িত থাকে তার বিচার হবে। কিন্তু কখনো হত্যা, চাঁদাবাজি- এ সবের অভিযোগ তার শত্রুরাও তার বিরুদ্ধে কখনো করে নি।”

রাব্বি স্ট্যাটাসে লেখেন, “অপরাধী হলে বিচারের আওতায় আসবে কিন্তু অপরাধ না করে শাস্তি পাওয়ার সংস্কৃতি আমরা মানবো না। আইভী অবশ্যই ন্যায় বিচার পাবে সরকার ও রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিবাদী ভূমিকার কথা, এমনকি নিজের দলীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত লোকজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কথা লিখেছেন মানবাধিকার কর্মী শহিদুল আলম, প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম, সাংবাদিক জ ই মামুন, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক আফজাল হোসেন পন্টি, সংস্কৃতি কর্মী অমল আকাশসহ অনেকেই।

জুলাইতে আন্দোলন চলাকালীন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও আইভী বা তার কোনো সমর্থককে এই ভূমিকায় দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে সকল নেতা-কর্মীকে মাঠে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও আইভী সে নির্দেশনার পরোয়া করেননি। এক মুহুর্তের জন্যও আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াননি। তার গ্রেপ্তারের পর জুলাইতে তার এই অবস্থানের বিষয়টিও তুলে ধরেন অনেকে।

আইভীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ অনেকে জানালেও কেউ কেউ তার সমালোচনাও সক্রিয় ছিলেন। তাদের অধিকাংশের মত, আইভীর ওসমানবিরোধী ভূমিকা আলোচিত হলেও আন্দোলন চলাকালীন তিনি ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে না দাঁড়ালেও সক্রিয়ভাবে পক্ষেও দাঁড়াননি। তার এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের পক্ষে মৌন সম্মতি উৎপাদন করেছে। এমনকি গ্রেপ্তারের সময় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটিও সমালোচনায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

তবে, আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গাড়িবহরে যুবদলের হামলার ঘটনাটি সারাদেশে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সকালে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু সড়কের কালিরবাজার মোড়ে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় আইভীকে বহন করা পুলিশের গাড়িতে ইট-পাটকেল ছোড়ে বিএনপির এ যুব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন দুই পুলিশ সদস্যসহ আইভীর বেশ কয়েকজন সমর্থক। গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ পেলে বিএনপির এ কার্যক্রম ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়