২৫ এপ্রিল ২০২৫

প্রেস নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১:৩৭, ১৬ মার্চ ২০২৫

যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুর গোপনীয়তা প্রকাশ, সমালোচনার মুখে বিএনপি

যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুর গোপনীয়তা প্রকাশ, সমালোচনার মুখে বিএনপি

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে যৌন নিপীড়নের শিকার ৮ বয়সী শিশুকে দেখতে ও তার পরিবারকে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বিএনপি। রোববার (১৬ মার্চ) সকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের নেতৃত্বে ভুক্তভোগীর বাড়িতে যান বিএনপির লোকজন। শতাধিক বিএনপির নেতাকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে ভুক্তভোগীর বাড়িতে হাজির হন তারা। এতে যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুকে জনসম্মুখে এনে তার ও পরিবারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, এতে ভুক্তভোগীর সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং প্রচলিত আইনও লঙ্ঘিত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ ও ছবিতে ভুক্তভোগী শিশু ও তার মাকে শতাধিক নেতাকর্মীদের সামনে রেখে কথা বলতে দেখা যায় আফরোজা আব্বাস ও বিএনপির নেতাকর্মীদের। এমনকি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সময় ভুক্তভোগীর মাকে ক্যামেরায় রেখে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে দেখা যায়। ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখার বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে ভুক্তভোগীর মাকে সাথে নিয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে কথা বলেন তিনি।যদিও যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীদের গোপনীয়তার বিষয়টি আইনের মাধ্যমেও সুরক্ষিত রাখা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিরা বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বরং তাদের ক্ষতি করেছেন তারা। জনসম্মুখে এনে পরিবারটিকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছেন। 

এই সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু, মাশুকুল ইসলাম রাজিব, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি, দলটির নারী ও শিশু আইনি সহায়তা সেলের সদস্য সামসুন নূর বাঁধন প্রমুখ।
এই সময় ভুক্তভোগী পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানও করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মহিলা দলের এ নেত্রী যখন ভুক্তভোগী শিশু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন তখন ওই ঘরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা গিজগিজ করছিলেন। উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ও স্থানীয় লোকজনও। এই সময় ভুক্তভোগী শিশু, তার মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরসহ ছবিও তোলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি উপেক্ষা তাদের ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

এমনকি ভুক্তভোগীর মাকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে কথা বলাতে সেসব ভিডিও ও ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টির মধ্য দিয়ে ভুক্তভোগীর সুরক্ষার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তাছাড়া, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এই বিষয়ে কড়া নিষেধের কথাও বলা আছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১৪ ধারায় ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ভুক্তভোগীর নাম ও ছবি প্রকাশ ও প্রচারে নিষেধ করা হয়েছে। এই ধারাটি কঠোরভাবে প্রয়োগেরও কথা বলা হয়েছে আইনে। এছাড়া, হাইকোর্টেরও এই বিষয়ে কড়া নির্দেশনা রয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি রিনা আহমেদ মনে করেন, ভুক্তভোগী ও তার মাকে জনসম্মুখে আনার মধ্য দিয়ে পরিবারটিকে আরও ‘বিপাকে’ ফেলা হয়েছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ কথা বলে এবং অন্যদেরও ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখার বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন রিনা।

তিনি বলেন, “আমরা মহিলা পরিষদ চাই, যাকে নির্যাতন করা হয় তার নাম, পরিচয়, ছবি কোনোভাবে যেন প্রকাশ না করা হয়। এমনকি সংবাদপত্রেও না। বরং অপরাধীকে মানুষের সামনে আনা উচিত, যাতে মানুষজন তাকে চিনতে পারে। ভিক্টিমের আইডেন্টিটি কোনোভাবেই ডিসক্লোজ করা যাবে না। কেননা, এই শিশুকে জনসম্মুখে আনার মানে হলো, তাকে পুনরায় মানসিকভাবে নির্যাতন করা। ভিক্টিমকে সামাজিকভাবে আরও কোনঠাসা করে দেওয়ার প্রক্রিয়া এটি। এতে ভিক্টিম তো আরও বিপাকে পড়ে গেলো।”

“আমরা মনে করি, যিনি নির্যাতন হয়েছেন তাকে পুনরায় নির্যাতন না করা। তাকে নিরবে মেন্টাল সাপোর্ট দেওয়া দরকার। এসব সেন্সেটিভ ব্যাপারে আমাদের আরও বিবেক-বুদ্ধি ব্যবহার করা উচিত”, যোগ করেন রিনা আহমেদ।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বিএনপির নারী ও শিশু আইনি সহায়তা সেলের নারায়ণগঞ্জ মহানগর ইউনিটের সদস্য সামসুন নূর বাঁধনের সাথে। তিনি বলেন, “ভিক্টিমের ছবি কিন্তু ব্লার করা হয়েছে এবং সেইভাবে ফেসবুকে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি কোন ছবি তুলে ভুলভাবে পোস্ট করে সেইটা তাদের ব্যাপার। আর সাংবাদিকদের সামনে কথা বলার সময় ভিক্টিম ছিলেন না কিন্তু মা ছিলেন এইটা সত্য। কিন্তু বিষয়টা এলাকার আশেপাশে সবাই জানে। তারপরও বিষয়টাকে এড়ানো যেতো।”

“যদিও গতকাল (শনিবার) আমি যখন ভিক্টিমের পরিবারের সাথে কথা বলি, তখন খুবই গোপনে বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই কথা বলেছি। যতটা মেনটেইন করা যায়, সেইভাবে করেছি। কিন্তু আজকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের লিডাররা এসেছিলেন। তাই চাইলেও সবটা মেনটেইন করা যায়নি। অনেক মিডিয়াতেও প্রচার করা হয়েছে, এইটার দায় কিন্তু আবার আমাদের না। সর্বোপরি আমি নিজেও ভিক্টিমের আইডেন্টেটি গোপন রাখার বিষয়টিকেই সমর্থন করি। আগামীতে বিষয়গুলো আরও হাইলি-মেনটেইন করা হবে। এ ব্যাপারে আরও নজর দেওয়া হবে”, যোগ করেন তিনি।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়