মেয়র আইভীর উপর হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী আজ

নারায়ণগঞ্জের ফুটপাতে হকার বসাকে কেন্দ্র করে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তার সমর্থকদের উপর হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী আজ। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারির এইদিন মেয়র আইভী নিজেসহ অর্ধ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। হামলার পর পর মেয়র আইভী অভিযোগ করেছিলেন হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর উপর হামলা করা হয়েছে। হামলার জন্য তিনি সরাসরি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানকে দায়ী করেন।
ঘটনার ২২ মাস পর মেয়র আইভীকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে নিয়াজুল ইসলাম খান, শাহ্ নিজাম, জাকিরুল আলম হেলাল, শাহাদাত হোসেন সাজনুসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে এক হাজার জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন নাসিকের আইন বিষয়ক কর্মকর্তা জিএম সাত্তার। এই মামলার তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। অভিযোগপত্রে তাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, জখম, ভাঙচুর ও নাশকতার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারির সকাল থেকেই চাপা উত্তেজনা ছিল নগরবাসীর মধ্যে। একদিকে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতের উপর থেকে হকারদের উচ্ছেদ করার পক্ষে অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান হকার বসানোর পক্ষে। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন যাবত উত্তেজনা বিরাজ করছিল শহরে। ১৬ জানুয়ারি বিকেলে পাল্টে যায় নগরীর চেনা রূপ। নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তাঁর সমর্থকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলি বর্ষণ, বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল এবং দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শহরের চাষাড়া এলাকা। সংঘর্ষে নাসিক মেয়র আইভীসহ উভয় পক্ষের শতাধিক আহত হয়। আহত হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও। এদের মধ্যে গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শরীফউদ্দিন সবুজ।
সংঘর্ষের সময় আতঙ্কে শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ ও র্যাব টহল দেখা যায়। সংঘর্ষের কারণে পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ওই দিন সংঘর্ষের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, নাসিক মেয়র শহরের সায়েম প্লাজার সামনে আসা মাত্র শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়া শামীম ওসমানের লোকজন আইভীর উপর প্রথমে হামলা করে। শামীম ওসমানের অনুগত বলে পরিচিত নিয়াজুল অস্ত্র হাতে মেয়র আইভীর দিকে তেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তাকে ধরে আইভীর লোকজন গণপিটুনি দেয়। এরপর শুরু হয় দফায় দফায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ। শামীম ওসমানের লোকজনের সাথে যোগ দেয় উচ্ছেদ হওয়া হকাররা। হামলা থেকে রক্ষা করতে আইভীর লোকজন মানবঢাল তৈরি করে চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন আইভীকে। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপের কারণে মানবঢালের লোকজন বেশি আহত হয়। আইভী নিজেও ইটের আঘাতে আহত হয়ে সড়কে বসে পড়েন। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও গুলি বর্ষণের ঘটনা চলে ঘন্টাব্যাপী।
তবে পুরো সংঘর্ষের সময় মেয়র আইভী সায়েম প্লাজার সামনে থেকে নড়েননি। সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হয়েছে। আহতদের নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও ৩০০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
এদিকে হকারদের শান্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সেলিম ওসমানের পক্ষে শহরে মাইকিং করা হয়।
শামীম ওসমানের নির্দেশেই হামলা: আইভী
সংঘর্ষের পর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, আজকে শামীম ওসমান রাইফেল ক্লাবে বসে থেকে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে আক্রমণ করেছে। যখন ঝড়ের বেগে ইট পাটকেল ও গুলি হলো তখন কোথায় ছিল প্রশাসন। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে এভাবে ঝড়ের বেগে এর আগে কোনোদিন আক্রমণ হয়নি। তাহলে শামীম ওসমান কীসের বলে, কোন প্রশাসনের ইঙ্গিতে, কার ইঙ্গিতে সাধারণ মানুষ ও আমার ওপর আক্রমণ করল? আমি তো আজকে একটা কথাও বলিনি। আমরা আজকে এসেছিলাম আপনাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এবং জানাতে যে কি নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর আছে, কি নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের আছে এবং আমরা কি করতে চাচ্ছি শহরের মানুষের জন্য হকারের জন্য এবং আমি কি কি সমস্যা সমাধান করেছি। এগুলো বলার অধিকার কি আমার নেই?’
ক্ষুব্ধ আইভী বলেন, আজকে উনি আমার উপরে আক্রমণ করেছে মানে নারায়ণগঞ্জের জনগণের উপর আক্রমণ করেছে। উনি কোন আক্রোশে আক্রমণ করেছেন। ২০১১ তে তার ভরাডুবি হয়েছে, ২০০৮ সালে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হননি এই কারণেই কি এই আক্রমণ করলেন?
অন্যদিকে সাংসদ শামীম ওসমান বলেন, এ সমস্ত ছোটখাটো গুণ্ডাপাণ্ডা মোকাবিলা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। আমার সব চেনা আছে, জানা আছে। প্রশাসনের ভূমিকা, যেটা নিয়েছেন, সেটা নিয়েছেন। মনে রাখবেন, যদি আমাদের মাঠে নামতে হয় তবে দুই-এক হাজার না, দুই-এক লাখ নামবে।
ঘটনার পর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে স্থানীয় দুইপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। দুপুর থেকে আমরা বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করেছিলাম। দুই পক্ষের উচ্ছৃঙ্খল কিছু লোক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে পুলিশ দু’পক্ষকে নিভৃত করে। আমরা চেষ্টা করেছি জনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে, দু’পক্ষকে শান্ত রাখতে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শর্টগান ও টিয়ারশেলের গুলি নিক্ষেপ করেছি।
আগের দিনও পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ছিলেন শামীম-আইভী
এই সংঘর্ষের আগের দিন ১৫ জানুয়ারি শহরের চাষাঢ়ায় হকাররা সমাবেশের ডাক দেন। ওই সমাবেশে উপস্থিত হন শামীম ওসমান। এ সময় তিনি হকারদের ফুটপাতে বসার নির্দেশ দেন। শামীম ওসমান হাতের ঘড়ি দেখে বলেন, ‘এখন বাজে সাড়ে চারটা। আমার প্রিয় হকার ভাইদের বলছি, আগামীকাল (১৬ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে নারায়ণগঞ্জে আবার হকার বসবে। এটা কোন অনুরোধ নয়, সুপারিশ নয়, এটা এমপি শামীম ওসমানের নির্দেশ। আগামীকাল থেকে আবার আমার হকার ভাইয়েরা এই নারায়ণগঞ্জে ব্যবসা করবে। কোন প্রশাসন অথবা যে কেউ যদি আমার এই হকার ভাই বোনদের গায়ে হাত দেয় সেটা আমি শামীম ওসমান দেখবো।
হুশিয়ারি দিয়ে শামীম ওসমান বলেন, কোন বিকল্প ব্যবস্থা না দিয়া যদি কেউ মনে করেন নারায়ণগঞ্জে হকার উঠাইয়া দিবেন, পারবেন। অবশ্যই পারবেন। শামীম ওসমানের মৃত্যুর পর, তার আগে পারবেন না। আমি আমার নেতাকর্মী যারা আছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নির্দেশ নিয়া দিলাম, যদি কোন মাস্তান, কোন ব্যক্তি হকারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে আসে তাদের প্রতিরোধ করবেন। বাকিটা আমি দেখবো।
এই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, শামীম ওসমান নির্দেশনা দেয়ার কে? নারায়ণগঞ্জ শহর শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকায় নয়। এটা ৫ আসনের এলাকা। যেহেতু এই আসনের এমপি একটি প্রস্তবনা দিয়ে দেশের বাহিরে গিয়েছেন সেখানে অন্য আসনের এমপি হকারদের এভাবে উস্কানি দিয়ে কাজটা ভালো করলো না। এটার কোনো মানে হয় না।
মামলার অভিযোগপত্র জমা
এই মামলার তদন্ত শেষে গত ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। অভিযোগপত্রে তাদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, জখম, ভাঙচুর ও নাশকতার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ্ নিজাম, যুবলীগ নেতা নিয়াজুল ইসলাম খান, হকার নেতা রহিম মুন্সি, আসাদুল ইসলাম ওরফে আসাদ, সায়মন, ইকবাল হোসেন, মাসুদ পাটোয়ারী ওরফে শুক্কুর, তোফাজ্জল, পলাশ মিয়া, মহসীন বেপারী, সালাউদ্দিন ওরফে সালাউদ্দিন গাজী, সাদেকুল ইসলাম। যে ১২ জনের নাম অভিযোগপত্রে এসেছে তার মধ্যে কেবল শাহ্ নিজাম ও নিয়াজুল ইসলাম খান এজাহারভুক্ত আসামি; বাকিরা এজাহারবহির্ভূত। একইসঙ্গে মামলার নয় আসামির বাকি সাতজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করেছে পিবিআই।
অভিযোগপত্রে পিবিআই উল্লেখ করেছে, মামলাটি শুরুতে সদর মডেল থানা পুলিশ তদন্ত করে; পরে তারা দায়িত্ব পায়। তদন্তে যুবলীগ নেতা নিয়াজুল ইসলাম খান ও শাহ্ নিজামের হাতে ঘটনার দিন পৃথক দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিলো বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ঘটনার দিন ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করেও আসামিদের হাতে পিস্তল দেখা যায়। তবে তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, নিয়াজুল ইসলাম খানের পিস্তলটির লাইসেন্স রয়েছে। পিস্তলটির প্রকৃত মালিক নিয়াজুল ইসলাম হওয়ায় তাকে অস্ত্র আইনের ১৯ (ক) ধারায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করে পিবিআই। এদিকে শাহ্ নিজামের হাতে থাকা পিস্তলটির বিষয়ে পিবিআই অভিযোগপত্রে বলছে, শাহ্ নিজামের নামে একটি বন্দুকের লাইসেন্স থাকলেও পিস্তলের লাইসেন্স নেই। ভিডিও ফুটেজে নিজামকে বিনা লাইসেন্সে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও পিস্তল জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিজ দখলে রাখতে দেখা গেলেও আসামি জামিনে থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ভিডিও ফুটেজে অস্ত্র দেখা গেছে। এইসব ফুটেজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সারা পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছে। আসামিপক্ষের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তদন্তকারী সংস্থা এমন অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে।