বন্দরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুইজন নিহত

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা ও অটো স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দুইজন নিহত হয়েছেন। শনিবার (২১ জুন) রাতে উপজেলার বন্দর রেললাইন ও পাশের শাহী মসজিদ এলাকায় এই ঘটনা ঘটে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার।
নিহতরা হলেন: বন্দর উপজেলার হাফেজীবাগ এলাকার প্রয়াত সাদেক আলীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস (৭০) এবং পাশের শাহী মসজিদ এলাকার প্রয়াত আব্দুল জলিল মুন্সির ছেলে মেহেদী হাসান (৪২)।
নিহত কুদ্দুস পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি এবং মেহেদী বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ইজিবাইক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য (বহিষ্কৃত) হান্নান সরকার এবং ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আবুল কাউসার আশার অনুসারীদের মধ্যে কয়েকমাস ধরেই দ্বন্দ্ব চলছিল। ওই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে গত শুক্রবার ও শনিবার দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
নিহতের স্বজন, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবুল কাউসার আশা ও হান্নান সরকারের মধ্যে সখ্যতা থাকলেও তাদের অনুসারীরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী রনি ও জাফর এবং অপর একটি পক্ষের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে জুয়ারি বাবু ও শ্যামল। কয়েকদিন আগে চুরির টিন বিক্রি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। গত শুক্রবারও এ নিয়ে তাদের দুইপক্ষের মারামারিতে অন্তত আটজন আহত হন।
এরই জেরে শনিবার বিকেলে উভয়পক্ষ শাহী মসজিদ, বন্দর রেললাইন ও হাফেজীবাগ এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দেন। সন্ধ্যায় বন্দর রেললাইন এলাকায় আব্দুল কুদ্দুসকে সড়কের উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথারি আঘাত করা হয় বলে জানান অন্তত দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী।
তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান আব্দুল কুদ্দুসের পরিবারের সদস্যরা।
তারা বলেন, কুদ্দুসের সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু তার ছেলে পারভেজ রনি ও জাফর গ্রুপের সদস্য। পারভেজকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তার বাবাকে ছুরিকাঘাত করে প্রতিপক্ষের লোকজন।
কুদ্দুসের ছোটভাই দুদু মিয়া বলেন, “বড়ভাই চায়ের দোকানে ছিলেন। তারে ডাইকা নিয়া পারভেজের কই জানতে চায়। পরে তারা ভাইরে এলোপাথারি ছুরি দিয়া আঘাত করে। ভাই নাকি বারবার তাগোরে কইছে, আমারে জানে মাইরো না। কিন্তু কিচ্ছু শোনে নাই। আমরা লাশ গিয়া পাইছি হাসপাতালে।”
এদিকে, আব্দুল কুদ্দুসের মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন করা হয় এলাকায়। টহলে ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। রাত সাড়ে দশটার দিকে রনি ও জাফর গ্রুপের লোকজন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী হাসানকে ধরে নিয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি ক্লাবের সামনে নিয়ে গিয়ে তাকে বেধরক মারধর করা হয়। রাত সাড়ে দশটার দিকে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানিয়েছে বন্দর থানা পুলিশ।
মেহেদীর বোনের স্বামী মাহফুজুল হক সৌরভ বলেন, “বন্দরে যখন মার্ডারটা হয় তখন মেহেদী ছিল বাড়িতে। ও থাকতো অন্তত এক কিলোমিটার দূরে আমিন আবাসিক এলাকায়। মার্ডারের পর প্রতিপক্ষের লোকজনকে খুঁজতে গেলে রাস্তায় মেহেদীরে পাইয়া যায়। মেহেদীরে তখন তুইল্লা নিয়া সিরাজউদ্দোল্লা ক্লাবে নিয়ে বেধরক মারে। বুকে, মাথা আর মুখমন্ডল একেবারে থেতলে দিছে। আমরা লাশ পাইছি হাসপাতালে।”
এই ঘটনার পর গত রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বন্দর রেললাইন এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন দেখা যায়। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারও।
যদিও ঘটনার পর থেকে উভয়পক্ষের লোকজন এলাকাছাড়া বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
এদিকে, ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কাউসার আশা বলেন, “রনি আর মেহেদীরা সব একই গ্রুপের লোক ছিল। ছাত্রদলের রাজনীতির সময় থেকেই দেখছি, তারা ছিল আপন দুই ভাইয়ের মতো। আওয়ামী লীগের আমলে দুইজনে একসাথে জেলও খাটছে। কিন্তু গত ছয়মাস ধরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল।”
এই দ্বন্দ্বে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে সাবেক এ কাউন্সিলর বলেন, “দুইজনই হান্নান সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল। স্থানীয় কারণে দুইজনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এইটার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মেহেদী ও রনি দু’জনই আমার ভাইয়ের মতো। আমার সঙ্গে হান্নান কাকারও কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিশোর গ্যাং ও মাদকের দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক কারণে আমাকে জড়ানো হচ্ছে। এটি পলিটিক্যাল কোনো ব্যাপার না।”
যদিও এ প্রসঙ্গে কথা বলতে হান্নান সরকারের মুঠোফোনের নম্বরে একাধিকবার কল করেও তার সংযোগ পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।
রনি-জাফর গ্রুপের নেতা জাফর বলেন, "আমি নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার আশার একজন কর্মী। বাবু-মেহেদী গ্রুপ আশার নাম ভাঙিয়ে এলাকায় মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করে। আমি এর প্রতিবাদ করায় হান্নান সরকারের নির্দেশে তারা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় পারভেজের বাবাকে হত্যা করেছে।"
এদিকে, দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার। রাতেই র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে অন্তত তিনজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
“স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড দু’টি ঘটেছে। এই ঘটনা তারা ঘটাইছে এবং যারা নেপথ্যে আছেন তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
এ ঘটনায় পৃথক দু’টি হত্যা মামলাও হবে বলে জানান জেলা পুলিশের শীর্ষ এ কর্মকর্তা।