আলোচিত না.গঞ্জের সাত খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ব্যস্ততম লিংক রোড। সড়কের দুই পাশে স্টেডিয়াম, জেলা আদালত, জেলা প্রশাসক আর পুলিশ সুপারের কার্যালয়। অদূরেই জেলা কারাগার। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাঁধা সেই সড়ক থেকেই দিনে-দুপুরে উধাও হয়ে গিয়েছিল দুটি গাড়িসহ সাতজন মানুষ। তাদের অপেক্ষায়, সন্ধানে পার হয় তিন দিন। স্বজনদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে মর্মান্তিকভাবে। ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার গাড়িতে থাকা তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন ও সিরাজুল ইসলাম লিটন, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের ক্ষতবিক্ষত লাশ। এর একদিন পর মেলে স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরের লাশ। সবার হাত-পা বাঁধা। লাশের সঙ্গে ঝোলানো ছিল ইটের বস্তা। শুধু তাই নয় প্রত্যেকটি লাশের নাভির কাছে ফুটো করে দেয়া হয়। যাতে লাশগুলো কোনো দিন ভেসে না উঠে। এমন ঘটনায় শোক আর ক্ষোভে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মানুষ। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশ। এমন ঘটনায় পুরো নারায়ণগঞ্জ রূপ নেয় শোক, কান্না, আতংক আর ক্ষোভের শহরে। ঘটনার তদন্তে নামে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত র্যাব-১১ এর কয়েক অসাধু কর্মকর্তা আর আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন! বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ও চাকরিচ্যুত হওয়ার পর সাত খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হন র্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ কয়েকজন র্যাব সদস্য। রিমান্ডে নিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ আর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা ও লাশ গুমের লোমহর্ষক নৃশংস কাহিনী।
অপহৃত ব্যক্তিদের অচেতন করে প্রথমে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে পরে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ নদীতে ফেলার সময় লাশগুলোর পেট চিরে দেয় তারা। জড়িত র্যাবের সদস্যদের জবানবন্দিতেই উঠে এসেছিল ঘটনার এমন নৃশংসতার বিবরণ।
মেজর আরিফ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন (২৭ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে নূর হোসেন তাকে ফোন করে বলেন, নজরুল নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছেন। তিনি খবরটি তারেক সাঈদকে জানান। তারেক সাঈদ তখনই নজরুলকে ধরার জন্য তাকে ও লে. কমান্ডার এম এম রানা কে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন।
নজরুলের গতিবিধি নজরদারি করতে মেজর আরিফ হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল ও সিপাহি তৈয়বকে কোর্টের ভেতরে পাঠান। বেলা সোয়া ১১টার দিকে একটি সিলভার কালারের মাইক্রোবাসে করে রানার টিমের সাত-আটজন সদস্য তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টায় লে. কমান্ডার এম এম রানা নিজের গাড়িতে করে এসে গাড়ি ছেড়ে দেন এবং মেজর আরিফের মাইক্রোতে গিয়ে বসেন। কিছুক্ষণ পর সিপাহী তৈয়ব ফোন করে আরিফকে জানান যে নজরুলের লোকজন তাঁকে সন্দেহ করে পুলিশে দিয়েছে।
লে. কমান্ডার এম এম রানা তার জবানবন্দিতে বলেন, ওই সময় মেজর আরিফ তাঁকে বলেন, ‘স্যার, নজরুল একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে সব সময় চার-পাঁচটি আর্মস থাকে। আমরা সিভিল ড্রেসে তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে আমাদের নূর হোসেনের লোক ভেবে গুলি করে বসতে পারে। আপনার ইউনিফর্মধারী প্যাট্রল টিমকে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় নজরুলকে আটকাতে হবে।’
লে. কমান্ডার এম এম রানা তার ইউনিফর্মধারী প্যাট্রল টিমকে নজরুলকে আটকানোর জন্য নির্দেশ দেন। নায়েক বেলাল আনুমানিক একটার দিকে মেজর আরিফকে ফোন দিয়ে জানান, নজরুল সাদা রঙের গাড়িতে এসেছেন। আরিফ তাঁর কাছ থেকে গাড়ির নম্বর জেনে নেন। দু-এক মিনিট পর সাদা গাড়ি এবং তার পেছনে অ্যাশ বা ছাই রঙের একটি প্রাইভেট কার আদালত থেকে বের হয়।
আরিফ জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘তখন আমি ও রানা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নজরুলের গাড়ির পিছু পিছু যাই। রানা ওই সময় নজরুলের গাড়ির বর্ণনা দিয়ে প্যাট্রল টিমকে ওই গাড়িটি থামাতে বলে। আনুমানিক দেড়টার দিকে প্যাট্রল টিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি কর্পোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটি থামায়। তখন আমরা নজরুলের গাড়ি থেকে নজরুলসহ পাঁচজনকে বের করে আমার মাইক্রোবাসে তুলি।’
আরিফ বলেছেন, ‘এ সময় আমাদের পেছনে একটি অ্যাশ কালারের প্রাইভেট কার থেকে একজন নেমে চিৎকার করতে থাকেন। তখন রানা ওই লোক ও তার ড্রাইভারকে তার মাইক্রোবাসে তোলেন। আমি ওই পাঁচজনকে মাইক্রোবাসে তুলে কাঁচপুরের দিকে রওনা দেই এবং রানাকে বলি আমার গাড়িটিকে ফলো করার জন্য।’
গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেকের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো হয়। নজরুল, চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম এবং অন্য একজনের মুখে মুখোশ লাগানো হয়। বাকিদের চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা হয়।
রানা তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঘটনাস্থলে প্যাট্রল টিমের সঙ্গে থেকে যাই এবং মেজর আরিফ ধৃত লোকদেরসহ মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে চিটাগাং রোডের দিকে চলে যায়। আমি সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আদমজীনগরে ব্যাটালিয়ন সদরে ফিরে অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে জানাই যে নজরুলসহ পাঁচ-ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আরিফ তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘সিও (তারেক সাঈদ) বলেন, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাতজনকেই গুম করে ফেলো। তার আদেশে আমি আমার ক্যাম্পের বেলালকে সাত সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য বলে মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নরসিংদীর দিকে চলে যাই। আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমি নরসিংদী র্যাবক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছাই। ওই সময় নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করে তার সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে দেখা করি।’
সুরুজের সঙ্গে দেখা করার আগে আরিফ কালো রঙের নকল দাড়ি ও গোঁফ লাগিয়ে নেন। সুরুজের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে তিনি ও তার সঙ্গে থাকা বাকিরা দুপুরের খাবার খান। আনুমানিক বিকেল চারটার দিকে মাইক্রোবাস শিবপুর উপজেলার দিকে রওনা দেয়। শিবপুর পেরিয়ে মনোহরদী এলাকায় একটি ফাঁকা জায়গায়রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
আনুমানিক রাত আটটার দিকে নারায়ণগঞ্জের দিকে রওনা দেন আরিফ। আনুমানিক নয়টার দিকে তারা নরসিংদীর ভেলানগর পৌঁছান। আরিফ সেখানে সৈনিক মহিউদ্দিনকে সাতটি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে বলেন। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাঁচপুরে পৌঁছে একটি পরিত্যক্ত পেট্রলপাম্পে অপেক্ষা করতে থাকেন। রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি থাকায় একটি ট্রলার কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তারেক সাঈদকে বলেন আরিফ।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আরিফ বলেন, ‘আমি তখন নূর হোসেনকে ফোন করে জানাই, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে যেন কোনো মানুষের জটলা না থাকে। রাত ১১টার দিকে আমি মাইক্রোবাস দুটিসহ কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএর ঘাটে পৌঁছাই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে ইটের প্যাকেটগুলো কাঁচপুরব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে বলি।’
রাত আনুমানিক ১২টার দিকে একটি সাদা মিতসুবিশি মাইক্রোবাসে করে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সৈনিক আরিফ, সৈনিক তাজুল ইটের প্যাকেটগুলো নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর ঘাটে আসেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রানার ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে আসে।
আরিফ বলেন, ‘তার (সিও) আদেশ পেয়ে আমি নায়েক হীরা ও সিপাহি তৈয়বকে মাইক্রোবাসে থাকা সাতজনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে বলি। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, হীরা, সিপাহি তৈয়ব, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম—এই আটজন মিলেআটককৃত সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর আমি সবার মৃতদেহ ট্রলারে লোড করতে বলি। আমার টিমসহ ট্রলারে উঠি এবং রানার টিম ও গাড়িগুলো ফেরত পাঠাই। আমরা রাত আড়াইটার দিকে ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছানোর পর আমার টিমের সদস্যরা প্রতিটিমৃতদেহের সঙ্গে এক সেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়।’
এসআই পূর্ণেন্দু বালা তার জবানবন্দিতে বলেন, নায়েক হীরা একজনকে ইনজেকশন দেওয়ার সময় তার হাত কাঁপায় আরিফ নিজেই বাকি ছয়জনকে ইনজেকশন দেন। এরপর বেলাল, হীরা ও আরিফ মিলে দুই মাইক্রোবাসে থাকা সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে তাদের শ্বাস রোধ করেন। তিনি আরও বলেন, নদীতে ফেলার সময়প্রতিটি লাশের নাভির কাছে চাকু দিয়ে ছিদ্র করে দেন বেলাল। পরে আরিফ বেলালের কাছ থেকে চাকু নিয়ে নিজেই বাকি লাশগুলোর নাভিতে ছিদ্র করে দেন।
লাশ ফেলে দিয়ে রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার দিকে আরিফ ও তাঁর দল নারায়ণগঞ্জ ঘাটে এসে পৌঁছায়। সেখানে তারেক সাঈদ আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। তারেক সাঈদ সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ঘটনার বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার নির্দেশ দেন।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম