কালের বিবর্তনে সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী মসজিদ

রাশেদুল ইসলাম রাজু (প্রেস নারায়ণগঞ্জ): নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন গোয়ালদি মসজিদ। প্রাক-মুগল যুগের ছোট্ট সুন্দর গোয়ালদি মসজিদটি এ এলাকার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। ঐতিহাসিক এই গোয়ালদী মসজিদটি বর্তমানে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, সোনারগাঁয়ের পানামনগর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রাম গোয়ালদিতে বাঁশ ঝাড়, আম আর কাঁঠাল গাছের জঙ্গলের আড়ালে এখনো টিকে রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি। এটি স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে নির্মিত।
মসজিদের শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী সৈয়দ আশরাফ আল-হোসাইনির পুত্র সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ-এর শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯) এটি নির্মিত হয়। জানা যায়, ৯২৫ হিজরির ১৫ শাবান মোতাবেক ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে মোল্লা হিজাবর আকবর খান এটি নির্মাণ করেন। প্রসঙ্গত আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আমলে বাংলার শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য উৎকর্ষ লাভ করেছিল।
বাংলাপিডিয়ায় রয়েছে, আলেকজান্ডার কানিংহাম শিলা লিপিটির একটি ছাপচিত্র গ্রহণ করে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলে পাঠান। হেনরি ফার্ডিন্যান্ড ব্লকম্যান আরবি ভাষায় লেখা এ লিপির পাঠোদ্ধার করে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে অনুবাদসহ এটি সম্পাদনা করেন।
সোনারগাঁয়ে হোসেন শাহর রাজত্বকালের যেসব শিলালিপি পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে এ শিলালিপি অন্যতম। মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে পাথর এবং ইটের ওপর আরব্য অলংকরণ লক্ষণীয়। দেয়ালগুলোর প্রশস্ততা ১ দশমিক ৬১ মিটার। চার কোণায় সুলতানি রীতিতে তৈরি চারটি খিলান-স্তম্ভ রয়েছে।
মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে (এখন ইট দিয়ে ভরাট করা) একটি করে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ রয়েছে। একমাত্র গম্বুজটির ভিত্তি চারকোণের চারটি স্কুইঞ্চ খিলানের উপর। ছাদের ভার রক্ষার জন্য মসজিদটির ভেতরে কালো পাথরের অলংকৃত স্তম্ভও রয়েছে।
পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে অলংকরণে সমৃদ্ধ তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ততর এবং কালো পাথরে খোদাইকৃত ফুলেল ও আরব্য নকশায় সৌন্দর্যমণ্ডিত। পার্শ্ববর্তী মিহরাব দুইটি পোড়ামাটির ফুলেল ও জ্যামিতিক নকশায় শোভিত।
পাথরের তৈরী কেন্দ্রীয় মিহরাবটি একটি খিলানকৃত প্যানেলের মধ্যে স্থাপিত। প্যানেলের উপরিভাগের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিকশিত সূর্যমুখীর নকশা। তার নিচে মিহরাবের বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলানটি একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অলংকৃত। মসজিদটির বাইরের দিকের চারকোণে রয়েছে ব্যান্ডযুক্ত চারটি গোলাকার পার্শ্ববুরুজ, যেগুলি মসজিদের বাঁকানো কার্নিশ পর্যন্ত উঠে গেছে।
সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যখন এটিকে ‘সংরক্ষিত’ ইমারত হিসেবে চিহ্নিত করে তখন এটি রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে মসজিদটিকে পুনর্গঠন করা হয়।
মসজিদের ইতিহাস সংবলিত একটি সাইনবোর্ড প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর টাঙিয়ে রেখেছে। তাতে লেথা আছে, মোগল আমলে ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের আগে সোনারগাঁয়ে বার ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ, মুসা খাঁ ও এর আগের স্বাধীন সুলতানদের রাজধানী ছিল। রাজধানী ও রাজসভার জন্য মনোরম ইমারত ছাড়াও মুসলিম শাসকেরা এখানে মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ করেন। তার মধ্যে এ মসজিদ অন্যতম।
আফজাল হোসেন নামে সোনারগাঁয়ের এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, সুলতানী আমলের গৌরবোজ্জল মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম সাক্ষী এই গোয়ালদী মসজিদ। গোয়ালদি মসজিদ সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগর, লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর ভ্রমণে এলে অনেকেই এই মসজিদটি ভ্রমণ করতে আসেন বলে জানান তিনি।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম