আকাশ ভরা সূর্য তারা

“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি
দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী”।
আমাদের এই পৃথিবীটা এত বড় আর বিশাল যে, কেউ যদি চিন্তা করে পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখবে তাহলে হয়তো তার পুরো জীবনেও সম্ভব হবে না। কিন্তু! আসলেই কি তাই?
পৃথিবীর সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হই। বিশেষ করে রাতের বেলায়, যখন ঝিকমিক করে ওঠে তারারা, মনে হয় যেন সারাটা আকাশ জুড়ে হীরে বসানো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। কত গান, কত কবিতা লিখেছে মানুষ তারাদের নিয়ে। রাতের আকাশের সাথে মানুষের এই বন্ধন কিন্তু খুব একটা নতুন নয়।বলতে গেলে, সভ্যতার শুরু থেকেই।
জ্ঞান বিজ্ঞানের যে অবারিত দিগন্ত আজ মানুষের সামনে, প্রযুক্তির একের পর এক উদ্ভাবনে সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠেছে জীবন, সেই বিজ্ঞানের সূচনাও বলতে গেলে আকাশ চেনার মাধ্যমেই। ব্যাপারটা খোলাসা করা যাক।
আমরা মানুষের সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানি যে, এক সময় আজকের মত এই ঘরবাড়ি, যানবাহন, অট্টালিকা কিছুই ছিল না। মানুষ বাস করতো গুহায়, ঘুরে বেড়াতো বনে-জঙ্গলে খাবারের জন্য। পরিধান করতো গাছের ছাল-বাকল, পশুর চামড়া। সেই মানুষই আজকের এই সভ্যতা নির্মাণ করল কিভাবে? সেটা কি আলাদিনের আশ্বর্য্য প্রদীপের মতো কোন দৈত্য এসে সব পাল্টে দিয়ে গেল? না, মানুষই পাল্টে দিয়েছে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে প্রকৃতির সাথে, সে লক্ষ করেছে দিনের সাথে রাতের অনেক পার্থক্য। জীবন পুরো পাল্টে যায় । হিংস্র জন্তুদের আনাগোনা বেড়ে যায় এবং ধীরে ধীরে মানুষ খেয়াল করেছে যে, এই রাত হওয়ার পেছনে দায়ী হলো সূর্য। কি! হাস্যকর লাগছে ? মনে হচ্ছে এটা আবার না বোঝার কি হলো, তাইতো? এইটাই কিন্তু মানুষের অনেক বড় আবিষ্কার। এই যে দিন-রাত হওয়ার সাথে আকাশের সূর্যের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া, এটা কিন্তু মানুষই জেনেছে, অন্য কোন প্রাণীর কিন্তু এই বোধশক্তি নেই। আর মানুষ জেনেছে বলেই তার টিকে থাকা সহজ হয়েছে। সূর্যের গতিবিধি লক্ষ করে মানুষ সময় জ্ঞান লাভ করেছে। কখন খাবারের খোঁজে বের হতে হবে আর কখন রাত হওয়ার আগেই লুকাতে হবে, এই বোধ তৈরি হয়েছে আকাশ দেখেই। এখনও এদেশের পাড়া-গাঁয়ের লোকজন সূর্যের অবস্থান দেখেই সময় হিসেব করে।
এইভাবে মানুষ বুঝতে শিখেছে যে, আকাশের সাথে তার জীবনের যোগসূত্র রয়েছে। সূর্য ডোবার পর জীবন বিপদজনক হলেও মানুষ খেয়াল করেছে যে, রাতের আকাশের সাথেও প্রকৃতির অনেক হিসেব নিকেশ আছে। তখন মানুষ ভাবত যে, দেব-দেবতারা আকাশে ঘুরে বেড়ায় আর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষের মন তারাদের মধ্যে দেবতাদের খুঁজে ফিরত এবং কখনও হয়ত পেয়েও যেত। কিছু কিছু তারা মিলে এমন সব আকৃতি তৈরি হতো, মানুষের কল্পনা-প্রসূত মন তাদের মধ্যে নানা ছবি খুঁজে পেত। মানুষ, কুকুর, পেয়ালা ইত্যাদি। আরো অসংখ্য ছবি। গুহার গায়ে প্রাচীন মানুষের আঁকা সপ্তর্ষি মন্ডলের সাতটি তারার আকৃতি পাওয়া গিয়েছে। শুধুমাত্র তারার ছবি এঁকে, দেবতা জ্ঞান করেই মানুষ বসে থাকেনি। সত্যানুসন্ধানী মানুষ জানতে চেয়েছে আরো কৌতুহলী মন তাকে ছুটিয়ে নিয়েছে অসীমের সন্ধানে। আর এই জীবজগতে এই কারণেই মানুষ সবচেয়ে আলাদা। শুধুমাত্র প্রকৃতির নিয়মকে মেনেই সে বসে থাকে না, সেটাকে কাজেও লাগাতে চায়। প্রকৃতিকে ব্যবহার করে নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনে। আর তা করতে গিয়েই তার সামনে উন্মোচিত হয় একের পর এক অজানার দুয়ার। যেন নাছোরবান্দা শিশুর একের পর এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে প্রকৃতিমাতা মেলে ধরছে তার সমস্ত রহস্যের ভান্ডার। এই জ্ঞান অন্বেষণের অবিরাম যাত্রার ফলে আমরা আজ জানি যে, এই পৃথিবীটা বিশাল তো নয়ই, এমনকি মহাবিশ্বে বিশালতার কাছে এটা একটা বিন্দুরও সমতুল্য নয়।
যে কথা বলছিলাম, আমাদের পৃথিবীর বিশালতা নিয়ে। প্রথম প্রথম মানুষ ভাবত আমাদের এই পৃথিবী পুরো মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। আর সূর্য এবং তারারা একে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এমনকি প্লেটো এরিস্টটল এর মতো জ্ঞানীরাও এই মত দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় এরিস্টার্কাস নামের একজন বলেছিলেন যে, পৃথিবী নয়, সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র, পৃথিবীসহ সবাই তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু এই মতামত তখন কেউ গ্রহণ করেনি। আসলে তখন মানুষের চিন্তা ছিল সীমাবদ্ধ, এই মতামত বুঝতে পারা তাদের জন্য একপ্রকার অসম্ভবই ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির এবং পর্যাপ্ত উপকরণ থাকায় আমরা নিজের চোখেই দেখতে পাই যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আমাদের এই পৃথিবীসহ আরো গ্রহ। কিন্তু একটু কথা রয়ে গেল। এরিস্টার্কাস কিন্তু বলেছিলেন যে, সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করে। আমরা আজ জানি যে, এই কথাটা কতটা ভুল, কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাটাও কিন্তু আসলেই বিস্ময়কর।
পৃথিবী হল সূর্য়ের চারপাশে ঘুরতে থাকা আটটি গ্রহের মধ্যে দূরত্বের দিকে থেকে তৃতীয় এবং ভরের দিক থেকে পঞ্চম। এর তুলনায় সূর্য প্রায় ১৩ লক্ষ গুন বড়। আর সূর্য,এর চারপাশে ঘুরতে থাকা আটটি গ্রহ এবং অসংখ্য গ্রহাণু, উল্কা, ধুমকেতু মিলে আমাদের এই অঞ্চলকে বলা হয় সৌরজগত। আবার এই সূর্য মিল্কিওয়ে নামক সর্পিলাকার গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে ২৭০০০ আলোকবর্ষ দূরের কোন এক প্রান্তে অবস্থিত। এই গ্যালাক্সিতে সূর্য বা এর মতো নক্ষত্রের সংখ্যা আনুমানিক ৪০০ কোটি। আর এই রকম গ্যালাক্সির সংখ্যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কুত প্রায় ১০০০ কোটি। ভাবা যায়? আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘চিন্তার চেয়ে কল্পনার শক্তি বেশি“। অথচ মহাবিশ্বের বিশালতা বুঝতে হলে চিন্তা শুধু নয়, কল্পনাও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। আমরা এতটুকু বুঝলাম যে, এই হাজার কোটি গ্যালাক্সির কয়েকশো কোটি তারার মধ্যে সূর্য একটি। সেই সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা অত্যন্ত ক্ষুদ্র এক গ্রহ পৃথিবী। সে পৃথিবীর মাঝে এক ছোট দেশ আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ। যেখানকার ৬৪টি জেলার মধ্যে কোন এক জেলার অসংখ্য বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে বসে তুমি এই লেখাটি পড়ছো। ভেবে দেখো তো, কতটা ক্ষুদ্র তুমি, আমি, আমরা, আমাদের এই পৃথিবী। (চলবে)
শওকত আলী