প্রিয় শত্রুকে ভালবাসার অভিশাপ দিলেন ইউএনও বীনা

প্রেস নারায়ণগঞ্জ: সম্প্রতি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম বীনাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনেও এই প্রসঙ্গ তোলেন দুই সাংসদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আলোচিত সেই ইউএনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে আরো একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি তার প্রিয় শত্রুকে ভালোবাসার অভিশাপ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে নিজ ফেসবুক একাউন্টে এই স্ট্যাটাসটি দেন তিনি।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, আমার প্রিয় শত্রু, কেন জানিনা বারবার তোমার টার্গেটে পরিণত হয়েছি! পৃথিবীর এত মানুষ থাকতে তোমার টার্গেট শুধুই আমি কেন জানি না? সেটা কি শুধুই ঈর্ষা না অন্যকিছু তা এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি! মনে পরে না কখনও তোমার মন্দ চেয়েছি বা তোমাকে অভিশাপ দিয়েছি। তবে এবার আমি না একজন মায়ের ভেতরের আত্মার দাবী ‘আমার সব প্রিয় ফুল, পাখি, ঝরা পাতা, ইটের দেয়াল, ধুলিকনা... আমার প্রিয় যা কিছু সব তোমায় ভালোবাসার অভিশাপ দিক’।
প্রসঙ্গত, গত ৪ ফেব্রুয়ারি হোসনে আরা বেগম বীনাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউএনও হোসনে আরা বীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নিজ একাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা নিয়ে তোলপাড় চলছে প্রশাসনে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো, আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হল এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলবো
আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি। আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোন সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আমি জানতে পারি, আমি দুমাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয় এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারন করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম। উল্লেখ্য, আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ ৪ ও নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি। একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত, ফাঁকিবাজী এই বিষয়গুলোকে কখনই পুজি করিনি। যখন যে পদে কাজ করেছি চেষ্টা করেছি শতভাগ নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে। সন্তানসম্ভবা হয়েও এর কোন ব্যতিক্রম আমি করিনি।
অথচ আমি সন্তানসম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলীর পায়তারা করেই চলেছিল। আমার সন্তানসম্ভবা হওয়াটাকেই সে বিভিন্ন মহলে আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অথচ এই সন্তান পেটে নিয়েই আমি অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি এবং আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কতৃক এপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি। আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ বিকালে রেগুলার চেকাপ করতে আমি হাজবেন্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি৷ চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমার হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য৷ এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায়, আমার সদাশয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে। আমার অপরাধ হলো, আমি সন্তানসম্ভবা, আর তার চেয়েও বড় কারণ হল সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির।
খবরটা শোনার পর আমি প্রচন্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি৷ উল্লেখ্য, আমি এ্যাজমার রোগী। প্রচন্ড মানসিকচাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। তাৎক্ষনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ড্ক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়৷ পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সি প্রিমেচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের ঘওঈট তে বেচে থাকার জন্য প্রানপন যুদ্ধ করে যাচ্ছে!
স্ট্যাটাসের এক পর্যায়ে সদর ইউএনও প্রশ্ন করে বলেন, আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কি অপরাধ ছিল? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, আমি জানিনা! তবে জানি একজন সব দেখেন তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের উপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোন কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তা কে বলবো তুমি এর বিচার করো! আর যারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন, ও সুস্থ হয়ে গেলে কোন কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।
প্রেস নারায়ণগঞ্জ.কম