স্টাফ রিপোর্টার: ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাসের অভিযোগ তুলে রংপুর সদর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপাড়ায় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। যার বিরুদ্ধে কথিত এই স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ ঠাকুরপাড়ার সেই টিটু রায়কে খুঁজছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।
পরিবার বলেছে, টাকা-পয়সা ধার-দেনা করে প্রায় সাত বছর ধরে সে এলাকাছাড়া। টিটু রায় ফেসবুক ব্যবহার তো দূরে থাক, কোনও পড়ালেখাই জানে না বলে দাবি করেছে তার পরিবার।
ঠাকুরগাঁও পুলিশ জানায়, ঠাকুরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা টিটু রায় নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লায় একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন। তিনি থাকেনও সেখানেই। কয়েকদিন আগে টিটুর নামে একটি ফেসবুক আইডিতে আপত্তিকর এক স্ট্যাটাস দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তোলেন এলাকাবাসী। এ কারণে পাগলাপীর, মমিনপুর, হাড়িয়াল কুঠিসহ আশেপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর আশেপাশের ৬-৭টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঠাকুরপাড়া গ্রামে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শত শত রাউন্ড টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। পরে পুলিশ গুলি চালালে আহত হন ছয় জন।
তাদের রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হামিদুল ইসলাম নামে এক তরুণ মারা যান। তবে এই সংঘর্ষের মধ্যেই ঠাকুরপাড়ার অন্তত ৩০টি বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ভাঙচুর করা হয় ২০টি বাড়ি। হামলাকারীরা বাড়িঘরের মালামাল, বাসনপত্র, গরু-ছাগলও লুট করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
এদিকে প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে মূল রহস্য জানার জন্য টিটু রায়কে খুঁজছে পুলিশ। তবে দুই দিন চেষ্টার পরও তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন এ তথ্য জানান।
ওসি কামাল উদ্দিন বলেন, ‘রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় হামলার ঘটনায় যার ফেসবুক আইডি থেকে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সেই টিটু রায়ের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তার সন্ধান পেতে পুলিশ কাজ করছে।’
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.শরফুদ্দিন বলেন, ‘রংপুরে হামলার ঘটনার পর থেকে বলা হচ্ছে অভিযুক্ত টিটু রায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আছে। কিন্তু ফতুল্লা একটি বড় এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। তাই তাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। দুই দিন ধরে পুলিশ তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। কিন্তু সে কোন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফতুল্লার কোন এলাকায় ভাড়া থাকে সে সম্পর্কেও কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।’
ঠাকুরপাড়াবাসী ও স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, এই গ্রামের মৃত খগিন্দ্র চন্দ্রের ছেলে টিটু রায়। সে লেখাপড়া করেনি, কোনোমতে নিজের নামটা শুধু স্বাক্ষর করতে জানে। টিটু রায়ের ছোট ভাই বিপুল চন্দ্র জানান, প্রায় সাত বছর আগে পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে ঢাকায় চলে যায় টিটু।
সে বিভিন্ন এনজিওর কাছে ঋণ নিয়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। পাওনাদারদের অত্যাচারে বাড়ি থেকে একাই পালিয়ে চলে যায়। এরপর সে কখনোই তার বাড়িতে ফিরে আসেনি। প্রায় পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ঢাকায় ডেকে নেয়। এখন সে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে স্ত্রীসহ কাজ করছে।
বিপুল বলেন, ‘তার (টিটু) সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনও যোগাযোগই নেই। বাবা অর্থের অভাবে আমাদের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। আমার বাবা ছোট একটি চায়ের দোকান করে কোনোরকমে সংসার চালাতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিটু রায়ের নামে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে বলে আমরা কয়েকদিন আগে শুনেছি। কিন্তু আমার ভাই টিটু তো লেখাপড়া জানে না। সে ফেসবুক চালাবে কী করে?’
বিপুল দাবি করেন, ‘আমাদের ধারণা অন্য কেউ টিটু রায়ের নামে ফেসবুকে আইডি খুলে এই অপকর্ম করেছে। বিষয়টি তদন্ত করলেই আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।’ বিপুল বলেন, ‘কয়েকদিন আগে থেকে ঠাকুরপাড়া গ্রামের পাশেই সলেয়াসার এলাকায় কিছু লোক এই ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার শুরু করে। তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য টিটুকেই অভিযোগ করে এবং এ জন্য হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপাড়া গ্রামে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। আমার ভাইকে এই ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে।’
এদিকে টিটু রায়ের মা অনিলা রানী বলেন, ‘সাত বছর ধরে আমার ছেলে বাড়িছাড়া। পাওনাদারের জ্বালায় সে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর আর কখনোই বাড়িতে আসেনি। আজ অবধি তার সঙ্গে কোনও কথাও হয়নি। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে আমার দিন গেছে।’
টিটুকে ফাঁসিয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। শুক্রবার হামলাকারীরা টিটু রায়ের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে আগুন দিয়েছে এবং মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। এ সময় পাশের কয়েকটি বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মালামাল লুট করা হয়েছে।
বিপিন চন্দ্র নামে বৃদ্ধ এক প্রতিবেশী বলেন, ‘যারাই এই হামলা চালিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক। আমাদের কী অপরাধ? আমাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, মালামাল লুট করা হলো কেন? এর বিচার না হলে আমাদের পক্ষে এখানে বসবাস করা সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কতক্ষণ পুলিশ আমাদের পাহারা দেবে। আমরা এখনও হামলার আশঙ্কা করছি। দায়ীদের অবিলম্বে তাদের নেতাদেরসহ গ্রেফতার করা উচিত।’
রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘যে ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা বলে এই হামলা চালানো হলো তা এখনও আমাদের হাতে আসেনি। আমরা সেটা পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের টিম নারায়ণগঞ্জে টিটুকে আটকের জন্য গেছে। তাকে পাওয়া গেলে ঘটনার রহস্য জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নস্যাৎ করার জন্য জামায়াত-শিবির হামলার এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।’
শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসে রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ফেসবুকে কারা স্ট্যাটাস দিলো, টিটু রায় আদৌ তা দিয়েছে কিনা সব বিষয় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
অপরদিকে জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।